আন্তর্জাতিক ডেস্ক:
কাবাঘর নিয়ে একটি ফটোশপ করা অশ্লীল ছবি ফেসবুকে পোস্ট করে এক কিশোর। কিন্তু ওই ছবি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পরে তা থেকে ব্যাপক অশান্তি ছড়িয়েছে বাংলাদেশ সীমান্ত লাগোয়া বসিরহাট অঞ্চলে।
সোমবার থেকে ওই এলাকায় অনেকটাই যুদ্ধাবস্থা চলছে। তবে বুধবার দফায় দফায় বৈঠকের পর কিছুটা শান্ত হয়। এরফলে বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই দোকানপাট খুলতে শুরু করেছিল বসিরহাট শহরে। পথের ধারে বাজারও বসে বেশ কিছু জায়গায়। বাদুড়িয়া, স্বরূপনগর থেকেও নতুন করে গোলমালের খবর ছিল না।
কিন্তু বেলা তিনটার পরেই হঠাৎ পাল্টে গেল পরিস্থিতি। ফের হাজার হাজার লোক নেমে পড়ল বসিরহাটের রাস্তায়। পুলিশকে লক্ষ্য করে চলল ইটপাটকেল। রাস্তায় জ্বলল টায়ার। ভাঙচুর হলো দোকানপাট। আগুন লাগানো হলো মোটরসাইকেলে ও গাড়িতে। এতে আবারো পরিস্থিতি নাজুক।
এদিকে পশ্চিমবঙ্গের বসিরহাট অঞ্চলে গত কয়েকদিনের সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার মধ্যেই সে রাজ্যের সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে পাড়ায় পাড়ায় শান্তি বাহিনী তৈরি করবে।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী জানিয়েছেন সব ধর্মের প্রতিনিধি, স্থানীয় ক্লাব, ছাত্র-যুবদের নিয়ে রাজ্যের প্রায় ৬০ হাজার নির্বাচনী বুথ ভিত্তিক শান্তি বাহিনী তৈরী করবে পুলিশ প্রশাসন।
কোনো ধরনের সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা যাতে না ছড়ায়, তার জন্য নজরদারির কাজ চালাবে এই বাহিনী।
অন্যদিকে উত্তর চব্বিশ পরগণার বসিরহাটে নতুন করে উত্তেজনা ছড়িয়েছে। বৃহস্পতিবার বিকেলে অবশ্য সেখানে পুলিশের সঙ্গে খন্ডযুদ্ধ বেঁধে যায় স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের নারী-পুরুষদের।
উত্তর চব্বিশ পরগণায় বাংলাদেশ সীমান্ত লাগোয়া বাদুরিয়া, বসিরহাট, দেগঙ্গা আর স্বরূপনগরে গত সোমবার থেকে চলতে থাকা সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ও হিংসাত্মক বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল মুসলমানদের কাছে অত্যন্ত পবিত্র কাবাঘরের একটি ফটোশপ করা ছবি ফেসবুকে পোস্ট করাকে কেন্দ্র করে।
এদিকে বসিরহাটের পরিস্থিতি সামলাতে বৃহস্পতিবার সকালে আরো ৪ কোম্পানি আধাসেনা পাঠাতে চেয়েছিল কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। কিন্তু পরিবেশ শান্ত দেখে রাজ্য তা নিতে চায়নি। দুপুরের পরে ফের গোলমাল শুরু হওয়ায় তারা সিদ্ধান্ত পাল্টায়। সন্ধ্যায় বাহিনী আনার জন্য নতুন করে চিঠি পাঠানো হয় কেন্দ্রকে।
পাশাপাশি এ দিনই দু’টি ধর্মীয় সংগঠন ‘হিন্দু সংহতি মঞ্চ’ এবং ‘মজলিস-এ-ইত্তেহাদুল মুসলিমিন’ (এমআইএম)-এর কার্যকলাপের উপরে নিষেধাজ্ঞা জারির সিদ্ধান্ত নিয়েছে নবান্ন।
স্বরাষ্ট্র দপ্তরের এক কর্তা বলেন, ‘‘সরকার ওই দুই সংগঠনের নেতা তপন ঘোষ এবং আসাদুদ্দিন ওয়াইসির বক্তৃতা যথেষ্ট প্ররোচনামূলক বলেই মনে করা হচ্ছে। সে কারণেই ওই সংগঠন দু’টির কার্যকলাপ, সভা-সমাবেশ, মিছিলের উপরে নিষেধাজ্ঞা জারির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।’
ফের কেন তপ্ত হয়ে উঠল বসিরহাট? বিক্ষোভকারীদের অভিযোগের তির বসিরহাট দক্ষিণের তৃণমূল বিধায়ক দীপেন্দু বিশ্বাসের দিকে। তাদের বক্তব্য, সোমবার যাদের হাত ধরে গোলমালের সূত্রপাত, সেই দুষ্কৃতীদের প্রশ্রয় দিচ্ছেন দীপেন্দু। তার নির্দেশে পুলিশ এ দিন বেছে বেছে সেই সব লোকেদেরই ধরেছে, গত তিন দিন ধরে যাঁরা আক্রান্ত। এই অভিযোগের সূত্র ধরে বিক্ষোভে স্লোগান ওঠে, ‘দীপেন্দু বিশ্বাসের বিচার চাই।’ তার বাড়িতে ভাঙচুর চলে বলেও জানিয়েছে পুলিশ। বসিরহাট শহরে বেশ কিছু তৃণমূল অফিসে ভাঙচুর করে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়।
দীপেন্দু অবশ্য তার বিরুদ্ধে ওঠা যাবতীয় অভিযোগ খারিজ করে দিয়ে বলেন, ‘সকালে দশ মিনিটের জন্য থানায় গিয়েছিলাম। আমার বিরুদ্ধে যা রটানো হচ্ছে, তা মিথ্যা। এ সব সত্যি প্রমাণিত হলে আমি বিধায়ক পদ ছেড়ে দেব।’ দীপেন্দুর বক্তব্য, দলের নির্দেশে তিনি এলাকায় শান্তি ফেরানোর জন্য বিভিন্ন লোকের সঙ্গে বৈঠক করছিলেন। এর মাঝে কিছু লোক তার বাড়ি আক্রমণ করে। পরিস্থিতি প্রতিকূল বুঝে সন্ধ্যার দিকে র্যাশফের গাড়িতে গোপনে তিনি এলাকা ছেড়ে চলে যান বলে জানাচ্ছে পুলিশের একটি সূত্রে খবর।
রাতের দিকে দীপেন্দুকে কলকাতায় ডেকে পাঠান তৃণমূল শীর্ষ নেতৃত্ব। আপাতত বসিরহাটে দলের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে অসিত মজুমদারকে। তিনি দলে দীপেন্দুর বিরোধী শিবিরের নেতা বলেই পরিচিত। যদিও দীপেন্দুর দাবি, দায়িত্ব বদলের খবর তার জানা নেই। নবান্নের একটি সূত্র জানাচ্ছে, পুলিশ-প্রশাসনের শীর্ষ স্তরেও কিছু রদবদল করা হবে।
গত কয়েক দিন দীপেন্দু ছিলেন বিদেশে। বুধবার সকালে ফেরেন। যান বসিরহাট থানায়। ফেরার পথে তার গাড়ি ঘিরে কিছু লোক হেনস্তা করে বলে অভিযোগ। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই পুলিশ শহরের বাড়ি বাড়ি ঘুরে ধরপাকড় শুরু করে। অভিযোগ, বেছে বেছে এক পক্ষকেই ধরা হচ্ছিল। ফলে নতুন করে আগুনে ঘি পড়ে। পুলিশ সাধারণ মানুষকে নিরাপত্তা দিতে এবং গোলমালের মূল মাথাকে ধরতে ব্যর্থ এই অভিযোগ ছিলই। এ দিন তার সঙ্গে যুক্ত হয় নিরীহ মানুষকে হেনস্তা করার অভিযোগ।
পরিস্থিতি এমন জায়গায় পৌঁছায় যে, বসিরহাট স্টেশনের কাছে পুলিশ, বিএসএফের গাড়ি ঘিরে ফেলে হাজার কয়েক লোক। কাঁদানে গ্যাসের শেল ফাটিয়েও পরিস্থিতি আয়ত্তে আনা যায়নি। আধাসামরিক বাহিনীর ভূমিকা ছিল কার্যত দর্শকের। হতাশ এক পুলিশ কর্তা পরে বলেন, ‘সব কিছু শান্ত হয়ে আসছিল। কে যে নতুন করে ধরপাকড়ের নির্দেশ দিল!’
পুলিশ বলছে, ওই ঘটনার জেরে বাদুড়িয়া, দেগঙ্গা, স্বরূপনগর আর বসিরহাট এলাকাগুলিতে সোমবার সন্ধ্যা থেকেই অশান্তি শুরু হয়। বহু মানুষ রাস্তা আর রেল অবরোধ করে থাকেন অনেক রাত পর্যন্ত।
বিভিন্ন মুসলিম সংগঠনের নেতারা অবরোধকারীদের বোঝাতে থাকেন যে অভিযুক্ত কিশোরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, কাজেই তারা যেন অবরোধ তুলে নেন। কিন্তু নেতাদের কথা শোনেন নি ওই অবরোধকারীরা।
গত চার দিনেও শান্তি ফিরেনি ওই এলাকায়। দু’পক্ষের বোমা-গুলির লড়াই, দোকান-বাজারে অগ্নিসংযোগ, জনতা-পুলিশ খণ্ডযুদ্ধের মতো ঘটনা থামেনি।
তবে বিক্ষিপ্ত ভাবে হলেও বুধবার বিকেলের পর থেকে বসিরহাট মহকুমার নানা প্রান্তে শান্তি ফেরাতে আলোচনায় বসল বিবদমান পক্ষগুলি। হাড়োয়ায় শান্তি মিছিল বেরোয়। প্রশাসনের উদ্যোগেও শান্তি বৈঠক হয়েছে স্বরূপনগরে।
সেখানে ছিলেন স্থানীয় সংসদ, বিধায়কেরা। পরিস্থিতি পুরোপুরি স্বাভাবিক করতে নতুন করে আরো চার কোম্পানি আধা সামরিক বাহিনী পাঠাচ্ছে কেন্দ্র এমন খবর থাকলেও পরে তা আসেনি। দিনের শেষে বসিরহাটের এসডিপিও নীতেশ ঢালি বলেন, ‘পরিস্থিতি অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে।’
তবে সকালের দিকেও কিছুটা শান্ত থাকলেও ঠিক দুপুরের পর থেকেই আবারো পরিস্থিতি পাল্টাতে থাকে। বসিরহাট স্টেশন-সংলগ্ন এলাকা, ভ্যাবলা, পাইকপাড়া, রামনগর, হরিশপুর, ট্যাঁটরাবাজারে একাধিক সংর্ঘষের ঘটনা ঘটে। বাজার-দোকান ভাঙচুর করে, আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। মার খেয়েছে পুলিশ, র্যাফ। সবমিলেই চারদিনেও পরিস্থিতি শান্ত হয়নি।