
ডিএমপির কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) প্রধান মনিরুল ইসলাম জানিয়েছেন, ২০১৯ সালের গ্লোবাল টেররিজম ইনডেক্সে এখন বাংলাদেশের অবস্থান ৩১ নম্বরে। বর্তমান স্কোর ৫.২৮০। অর্থাৎ এ দেশে সন্ত্রাসবাদের প্রভাব বর্তমানে মাঝারি মাত্রার।
তিনি বলেছেন, বাংলাদেশ সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমন এবং ঝুঁকিমুক্তির দিক থেকে ৬ ধাপ এগিয়ে ৩১তম অবস্থানে আছে।
আজ শনিবার জাতীয় প্রেসক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে সেন্টার ফর সোশ্যাল অ্যডভোকেসি এন্ডরিসার্চ ফাউন্ডেশন (রিসার্ফ) আয়োজিত ‘উগ্রবাদ রোধে গণমাধ্যমের ভূমিকা’ শীর্ষক সেমিনারে তিনি এসব কথা বলেন।
মনিরুল ইসলাম বলেন, ২০১৮ সালের সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ২৫তম। এর আগের বছর বাংলাদেশ ছিল ২১তম। অর্থাৎ সন্ত্রাসবাদ দমনে ধারাবাহিকভাবে উন্নতি করছে বাংলাদেশ। সব মিলিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে এবার বাংলাদেশের অগ্রগতি সবচেয়ে বেশি।
তিনি বলেন, ‘গ্লোবাল টেররিজম ইনডেক্স (জিটিআই) হলো প্রতি বছর ইনস্টিটিউট ফর ইকোনমিকস অ্যান্ডপিস (আইইপি) দ্বারা প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন। সূচিটি ২০০০ সাল থেকে সন্ত্রাসবাদের মূল বৈশ্বিক প্রবণতা এবং নিদর্শনগুলোর সার সংক্ষেপ সরবরাহ করে। গত বছরের নভেম্বরে সিডনিভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট ফর ইকোনমিকস অ্যান্ড পিসের (আইইপি) বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদসূচক-২০১৯ প্রকাশিত হয়।
তিনি বলেন, ২৩টি গুণগত ও পরিমাণগত নির্দেশকের ভিত্তিতে বিশ্বের ১৬৩টি দেশেরপরিস্থিতি নিয়ে তৈরি করেছে বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদ সূচক-২০১৯। এসব দেশের জনসংখ্যা বিশ্বেরমোট জনসংখ্যার ৯৯ দশমিক ৭ শতাংশ বলে উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। এ প্রতিবেদনে বাংলাদেশেরঅবস্থান ছয় ধাপ উন্নতি হয়ে ৩১তম। স্কোর ৫.২০৮। অর্থাৎ এ দেশে সন্ত্রাসবাদের প্রভাবমাঝারি মাত্রার।
প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে সিটিটিসি প্রধান জানান, সন্ত্রাসী হামলার সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে আছে আফগানিস্তান, যার স্কোর ৯.৬০৩। বিশ্বের প্রতি বিশটি ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার মধ্যে ১৬টিই হয় আফগানিস্তানে। এছাড়া ২য়, ৩য় ও ৪র্থ অবস্থানে আছে যথাক্রমে ইরাক, নাইজেরিয়া ও সিরিয়া। ৫ম অবস্থানে আছে পাকিস্তান। বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদ সূচকে ভারতের অবস্থান এখন সপ্তম। এই অঞ্চলের মালদ্বীপ বাদে বাকি সাত দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ। বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে নেপাল (বৈশ্বিক তালিকায় ৩৪তম), শ্রীলঙ্কা (৫৫তম) ও ভুটান (১৩৭তম)। এই অঞ্চলে আফগানিস্তান বাদে বাকি ছয় দেশ ২০১৮ সালে সন্ত্রাসবাদ পরিস্থিতিতে উন্নতি করেছে। এই ছয় দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অগ্রগতি হয়েছে বাংলাদেশের।
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা কাজ করতে গিয়ে দেখেছি উগ্রবাদ ও সন্ত্রাস দমনে গণমাধ্যমের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। একটা ঘটনা ঘটার পর মিডিয়া প্রচার করার পর জনগণ এবং সরকারকে প্রভাবিত করে, যার ফলে ঘটনার সুষ্ঠু বিচার ও নিরাময় সম্ভব। এছাড়া মিডিয়ার সহায়তা নিয়েই আমরা বিভিন্ন সচেতনতামূলক তথ্য প্রচার করি। সন্ত্রাস দমনের পৃথিবীর অনেক দেশ বাংলাদেশকে রোল মডেল মনে করে।’
সেমিনারে তিনি উগ্রবাদ বা জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় বাংলাদেশের প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াকে সতর্কভাবে সংবাদ পরিবেশনের আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে গণমাধ্যম বড় ভূমিকা রাখতে পারে। জঙ্গিদের মৃত্যুর ঘটনা কোনোভাবে যাতে ইতিবাচকভাবে উপস্থাপিত না হয় সেদিকে বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখতে হবে। অনেক সময় টেররিস্টরাও মিডিয়া কাভারেজ চায়। যদি তাদের মতো করে কাভারেজ না হয় তাহলে টেরোরিস্টরাও মিডিয়া এবং মিডিয়াকর্মীদের ওপর আঘাত করে। লাইভ টেলিকাস্টের সময় সচেতন থাকা দরকার। কারণ একটা ঘটনার সময় যদি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সেখানে থাকে এবং সেটা যদি লাইভ টেলিকাস্টের মাধ্যমে জঙ্গিরা জানতে পারে তাহলে তারা বেছে বেছে তার ওপরে হামলা করবে। তাই গুরুত্বপূর্ণ কোনও ঘটনায় লাইভটেলিকাস্ট না করাটাই ভালো।’
একাত্তর টিভির কর্ণধার মোজাম্মেল বাবু বলেন, ‘বাংলাদেশে ২০টির বেশি টেলিভিশনের দরকার নাই। কিন্তু সরকার লাইসেন্স দিয়েছে ৪০টি। এতে সমস্যা দেখা দিচ্ছে। এভাবে আমাদের শক্তি কমিয়ে ফেলা হচ্ছে। মূলধারার মিডিয়ায় ছাঁটাই চলছে। আবার সরকারের কাজ মিডিয়ার টুঁটি চেপে ধরা নয়, কিন্তু সত্য প্রচারেরও টুঁটি চেপে ধরা হয়। একটি নিউজ অন এয়ার করা হলে স্টাবলিশার (সরকার) থেকে বলা হচ্ছে- থামান। লাইনে লাইনে সংশোধন করতে হচ্ছে। আমাদের ওপর আস্থা নেই স্টাবলিশারের। কিন্তু আপনি কিছু না দেখালে গুজব আরও বেশি ছড়াবে।’
মতিঝিলে হেফাজতের ঘটনার কথা মনে করিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রথমে লাইভ বন্ধ করতে বলা হলো, আমরা মিনিটে মিনিটে দেখালাম। যারা বন্ধ করতে বলেছিল, পরে তারাই আবার ফুটেজ চেয়েছিল। গুজব বন্ধ করতে হলেও সত্যটাই প্রকাশ করতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘নির্বাচনের সময় কেউ কি বলতে পারবো কোথাও ত্রুটি-বিচ্যুতি হয়নি? একটা ঘটনা ঘটলেই হলো। আমাদের নিউজ বন্ধ করতে বলা হচ্ছে। কেন্দ্রে বিএনপি বা সরকারি দলের প্রতিপক্ষের এজেন্ট নেই, এটা লাইভ দেখাতে নিষেধ করা হলো, দেখানো যাবে না। কিন্তু আমরা যদি ওই এজেন্টকে খুঁজে বের করে দেখাই যে, সে বাসা থেকে বের হয়নি, কেন্দ্রে আসবে কীভাবে? এতে কি স্টাবলিশার (সরকার) লাভবান হতো না? আজ আইপি-টিভি নিয়ন্ত্রণে নাই। অথচ আমাদের জবাবদিহি করতে হচ্ছে।’
সিনিয়র সাংবাদিক মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল বলেন, ‘বাংলাদেশের মূলধারার মিডিয়াগুলো এখন আর ধর্ষণের শিকার নারীর ছবি প্রচার করে না। অনেক ক্ষেত্রে পরিচয় ছাপা হয় না। এক্ষেত্রে অনেক পরিবর্তন এসেছে।’
জিটিভি ও সারাবাংলা ডটনেটের প্রধান সম্পাদক সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা বলেন, কোথায় জঙ্গি আটক বা গ্রেফতার হলে পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে জেহাদি বইসহ যোদ্ধা আটক হয়েছে। কিন্তু এই ধরনের শব্দ ব্যবহার করলে জঙ্গিবাদকে এক ধরণের উদ্বুদ্ধ করা হয়। সবাই রেসপনসিবল জার্নালিজম করতে বলেন, কিন্তু গুড ডেমোক্রেসির কথা বলেন না। গুড ডেমোক্রেসি না হলে গুড জার্নালিজম হবে না।
এটিএন বাংলার হেড অব নিউজ জ ই মামুন বলেন, ‘জঙ্গিবাদ দমনে সরাসরি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ভূমিকা বাড়াতে হবে। পুলিশকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে। ২০১৫ সালের প্যারিস হামলার পর এক থেকে দেড় কিলোমিটারের মধ্যে পুলিশ কাউকে এমনকি এমপি-মন্ত্রী-রাষ্ট্রপতিকেও ঢুকতে দেয়নি। আমাদেরও এই বিষয়গুলো খেয়াল রাখতে হবে। ’
মাছরাঙ্গা টিভির হেড অব নিউজ রেজওয়ানুল হক রাজা বলেন, হলি আর্টিজানের সময় নিবরাজদের ৫ জনের হাসির ছবি অনেক মিডিয়ায় ছাপা হয়েছে। সেটা ছাপা ঠিক হয়নি। একজন ওয়াজে দেলাওয়ার হোসেন সাঈদী সুনাম ও নারী নেতৃত্ব বিরোধী কথা বলে দ্রুত জনপ্রিয়তা পেলেন। এটা নিয়ে আপনাদের কাজ করতে হবে।
এনটিভির বার্তা প্রধান জহিরুল আলম বলেন, ‘মিডিয়ার নিজেদের পক্ষ থেকে বেশি কিছু করার থাকে না। কারণ আমরা নানা সংকটে থাকি। সিটিটিসি যদি মিডিয়ার জন্য গাইডলাইন তৈরি করে তাহলে ভাল হতো।’
তিনি আরও বলেন, ‘কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনে একটি সহিংস ঘটনার কথা মনে আছে। যেটা মূল ধারার মিডিয়ায় না আসলেও সোশ্যাল মিডিয়ায় কিন্তু ছড়িয়ে পড়ে।’
একুশে টিভির মোস্তফা মহসিন আব্বাস বলেন, ‘আমরা কোনও টেররকে হিরো বানাবো না? আমাদের বেসরকারি টেলিভিশন শিল্পের বয়স মাত্র ২০ বছর। এটা খুবই কম সময়। আমাদের এই শিল্পের নীতি নির্ধারণ নিয়ে এখনো পরীক্ষা নিরীক্ষা চলছে।’
ডিবিসি নিউজের সিইও মঞ্জুরুল ইসলাম বলেন, ‘রাষ্ট্রের সঙ্গে গণমাধ্যমের স্থায়ী বোঝাপড়া থাকবে। জঙ্গিবাদ গবেষণা রাষ্ট্রীয় গবেষণার চেয়ে অগ্রসরমান, সেভাবেই তারা সামনে এগিয়ে যায়। বিভিন্ন মাদ্রাসা, মসজিদ, স্কুলের এখনও জঙ্গি রিক্রুট হচ্ছে। আধুনিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও জঙ্গি রিক্রুট হচ্ছে। এসব নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে যেন ধর্মপ্রচার বন্ধ না হয়। গণমাধ্যমের চেয়েও বড় প্রতিদ্বন্দ্বী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম।’