
প্রকাশ্যে ব্যবহার হচ্ছে এসিড। শহর কিংবা গ্রামে রাস্তার ধারে জুয়েলারি স্বর্ণ গালানোর কাজ চলছে প্রতিদিন। ফলে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে ব্যবহারকারী সহ পথচারী। মানছে না ব্যবহার বিধি, নেই এসিড ব্যবহার বা বহনের লাইসেন্স। নাটোরের সোনার অলংকারের সুনাম রয়েছে দেশজুড়ে। অথচ বেশ কিছু ক্ষেত্রে নিয়ম নিতীর তোয়াক্কা করেন না স্বর্ণশিল্পের সঙ্গে জড়িতরা। ১৯৫০ সালের দিকে নাটোর শহরের কাপুড়িয়া পট্টি, পিলখানা,রসুলের মোড় সহ লালবাজার এলাকায় হাতে গোনা কয়েকটি দোকান দিয়ে জুয়েলার্স ব্যবসার সূত্রপাত ঘটে। কালের বিবর্তনে তা এখন বেড়ে দুশ’তে ঠেকেছে। এছাড়া স্বর্নালংকার তৈরির জন্য ওই একই এলাকায় শতাধিক কারখানাও গড়ে উঠেছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, এখানকার কারখানার কাজে ব্যবহৃত নাইট্রিক এসিড ও সালফিউরিক এসিড নিঃসৃত ধোঁয়া কারখানার স্বল্প দৈর্ঘ্য পাইপ দিয়ে পৌঁছে যাচ্ছে পাশের বাড়িঘরে। দরজা-জানালা বন্ধ করেও রক্ষা পাচ্ছেন না ভুক্তভোগীরা। ফলে জনজীবন বিপর্যস্থ হয়ে পড়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায় বেশির ভাগ দোকানে নেই এসিড ব্যবহারের লাইসেন্স। সদর উপজেলার পিলখানা স্বর্ণকারপট্টি এই পথে রথবাড়ি, কালুরমোড়, তেলকুপি, আমহাটি সহ প্রায় দশ গ্রামের মানুষ প্রতিদিনের চলাচলের একমাত্র পথ এটা। কালুরমোড়ের পথচারী মো. ইয়াকুব জানান প্রায় প্রতিদিন তারে নিচাবাজরে আসতে হয় রিক্সা বা ইজি বাইকে চলাচল করতে তেমন অসুবিধা না হওলও পিলখানা দিয়ে হাটতে অসুবিধা হয়। অনেক সময় হাটতে গেলে নিঃশ^াস বন্ধ করে চলতে হয় এই পথে কারণ এসিডের ধুয়ায় আচ্ছন্ন থাকে এই পথ। নাটোর সদরের এসিড ব্যবসায়ী ইউসুফ আলী জানান, প্রতি মাসে অন্তত তিন টন এসিড বিক্রি করে থাকেন। এর মধ্যে জুয়েলার্স কারখানায় মাসে অন্ততঃ পাঁচ থেকে ছয় মন এসিড ব্যবহার করা হয়। এসিডের গ্যাসের বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে কাপুড়িয়াপট্টি, পিলখানা ও লালবাজার এলাকায় বসবাসকারী অন্তত দুইশতাধিক পরিবারের লোকজনের জীবন দূর্বিসহ হয়ে উঠেছে। শ্বাসকষ্ট, হৃদরোগ, চর্মরোগ, চক্ষুসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন এখানকার মানুষ। স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ছেন পথচারীসহ স্বর্ণ শিল্প কারিগররাও। শহরের পিলখানার স্বর্ন কারিগর অঞ্জন জানান, কারখানায় কাজ করতে গেলে নাক মুখ জ্বালাপোড়া করে। একাজে কোন জটিল রোগ হতে পারে এমন আশঙ্কা নিয়েই শুধু জীবন কাটানোর জন্য একাজ করতে হয় তাদের। সদর উপজেলার ৭নং হালসা ইউনিয়নের হালসা বাজার। বাজারের আমিন জুয়েলার্সে দেখা গেল তিনি পথের ধারে এসিড দিয়ে সোনা পরিস্কারের কাজ করছেন আর এসিডের ধোঁয়ায় ভরে গেছে রাস্তা। নবম শ্রেণিতে পড়–য়া স্কুল ছাত্রী মোছাঃ রেবেকা খাতুন জানালেন প্রতিদিন স্কুল যাওয়া আসা করতে হয় এই দোকানের সামনে দিয়ে। এসিডে ধোঁয়া নাকে লাগলে নিঃশ^াস নিতে কষ্ট হয়। আমিন জুয়েলার্স এর মালিক মো. শরিফুল ইসলামের কাছে এসিড ব্যবহার লাইসেন্স দেখতে চাইলে তিনি জানালেন তার লাইসেন্স নেই। কোথা থেকে কেনা হয় এসিড? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান হালসা বাজারের সব দোকানে একজন বাবাজি এসিড দিয়ে যায়। তার কাছ থেকে সবাই এসিড কিনে ব্যবহার করে। তার কোন মুঠোফোন নেই। নাম সাত্তার বাড়ি নাটোর পৌরসভার ২নং ওয়ার্ডের বঙ্গজ্জল এলাকায়। বঙ্গজ্জল এলাকা খোঁজ করে সাত্তার নামক এসিড বিক্রেতাকে পাওয়া গেল না। ২নং ওয়ার্ডের কমিশনার ফরহাদ হোসেন জানালেন তার জানামতে একজন সাত্তার আছে যিনি ডিসি অফিসে চাকরি করে আর একজন সাত্তার আছে সে ব্যাংকার। তবে কি আমিন জুয়েলার্স এর মালিক মিথ্যা বলেছে। এছাড়া লালপুর উপজেলার গোপালপুর বাজার গুরুদাসপুর উপজেলার চাঁচকৈড় বাজার, নাজিরপুর বাজার সহ জেলার ৭ উপজেলার স্বর্ণশিল্প সরজমিনে দেখা যায় রাস্তার ধারে ব্যবহার করছে এসিড যাদের বহন লাইসেন্স বা ব্যবহার লাইসেন্স নেই। নলডাঙ্গা উপজেলার নলডাঙ্গা বাজার থানার সামনে রয়েছে সাধনা জুয়েলার্স। দোকানের সামনে তিনি এসিড দিয়ে সোনা পরিস্কার এর কাজ করেন। পথচারী মো. আলাউদ্দিন জানালেন নলডাঙ্গা হাটের দিন বহুলোকের সমাগম হয় এই হাটে কিন্তু স্বর্ণ ব্যবসায়ী এসিডের কাজ করে রাস্তার ধারে ফলে এসিডের ধোয়ার কারণে এই টুকু পথ চলতে অসুবিধা হয়। দোকান মালিক অমৃত কুমার নান্টুর কাছে এসিড ব্যবহার লাইসেন্স দেখতে চাইলে তিনি জানালেন এসিড লাইসেন্স তার আছে কিন্তু তা দেখাতে অক্ষম হলেন তিনি। জেলার সবকটি উপজেলা ঘুরে দেখা যায় গড়ে ওঠা অধিকাংশ জুয়েলার্স কারখানায় এসিড ব্যবহারের বিধি নিষেধ মানা হচ্ছে না। তাদের কারও নেই এসিড ব্যবহারের লাইসেন্স এমনকি বহনেরও লাইসেন্স নেই কারও। এসব কারখানায় সকাল থেকে রাত পর্যন্ত নির্গত হচ্ছে এসিড পোড়ানোর গ্যাস। স্থানীয়দের অভিযোগ, এখানকার অধিকাংশ জুয়েলারী কারখানার পরিবেশগত ছাড়পত্র নেই। এসিড ব্যবহারের বিধি মানছেন না। সংশি¬ষ্ট দপ্তরগুলোকে স্মারকলিপি ও জুয়েলারি মালিক সমিতিকে একাধিকবার লিখিত অভিযোগ দিয়েও কোন প্রতিকার পাওয়া যায়নি। জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের সিনিয়র স্বাস্থ্য শিক্ষা কর্মকর্তা সরকার শফিকুল ফেরদৌস জানান, এসিডের ধোঁয়া মানব দেহের জন্য ক্ষতিকারক। এই ধোঁয়ার কারণে মানুষের শ্বাস কষ্ট, চর্মরোগ হতে পারে। এমনকি হৃদরোগ সহ নানা ধরনের শারিরিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। পরিবেশ অধিদপ্তর এর রাজশাহী বিভাগের বিভাগীয় পরিচালক মো. আশরাফুজ্জামান জানান আবাসিক এলাকায় এসিড পোড়ানো যাবে না। নিয়মানুসারে প্রত্যেক কারখানা স্থাপনের সময় পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমতিপত্র নিতে হবে। নাটোরের অনেক কারখানায় অনুমতি নেই। এসব অবৈধ কারখানার বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসনই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারেন। জেলা প্রশাসক শাহিনা খাতুন জানান, এব্যাপারে কোন অভিযোগ পাননি। স্বর্ন ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলবেন এবং তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা গ্রহণসহ সামাজিক উদ্বুদ্ধকরণ ব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে সমস্যা সমাধানে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে বলে জানালেন তিনি।