আজ সেই ভয়াল ২৪ এপ্রিল। পোশাক শ্রমিকদের জীবনের সবচেয়ে শরনীয় দিন। সেদিনের ভোরটা অন্যদিনের মতো হলেও বেলা শুরু হতেই সকাল ৯টার দিকে অনলাইনে চোখ বুলিয়ে বা টেলিশিনে তাকিয়ে থমকে ওঠে দেশবাসী। অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখেন, সাভারে রানা প্লাজা নামে একটি গার্মেন্টস ভবন ধ্বসে পড়ে আছে আরেকটি ভবনের উপর। ভবনটির ভেতরে হাজারের ওপর মানুষ ছিলেন কর্মরত। ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়া শ্রমিকের আর্তনাদে ভারী হয়ে ওঠে সাভার। থমকে দাঁড়ায় পুরো জাতি। চাপা পড়ে সেদিন প্রাণ হারান প্রায় এক হাজার ১৩৪ জন শ্রমিক। আর আহত হয় আরও আড়াই হাজার হতভাগা শ্রমিক।
আহত ব্যক্তিদের নিয়ে যাওয়া হয় এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। কলেজের ছাত্ররা সাহায্যের জন্যে নিজেদের মেলে ধরেন। আহতের চিৎকারে ভারী হয়ে থাকে চারপাশ। এনাম মেডিকেলের পেছনের আঙিনায় চাটাইতে বিছিয়ে রাখা হয় লাশের সারি। সেদিন সব লাশের স্বজনেরা এসেও পৌঁছেনি।গ্রাম থেকে ছুটে হতাহত শ্রমিকদের পরিবারের সদস্যরা। লাশের চেহারা দেখে চেনা যায় না। মেয়ের কানের দুল, হাতের বালা দেখে চেনার চেষ্টা করেন বাবা-মা। মায়ের চুল দেখে, কাপড়ের কোনা দেখে চেনার চেষ্টা করে সন্তান। বাবার খোঁজে রানা প্লাজার সামনে দিনের পর দিন ঠাঁয় দাড়িয়ে থাকে শিশু সন্তানরা। এক হাতে সন্তানের ছবি নিয়ে আরেক হাতে চোখের জল মোছেন বাবা-মা।
ঐদিন সকাল ৮টায় রানা প্লাজায় একযোগে চালু করা হয় ডজনখানেক জেনারেটর। এতে কেঁপে ওঠে নয়তলা ভবনটি। এর কিছুক্ষণের মধ্যে বিশাল এ ভবনটি ধসে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে নিভে যায় হাজারো শ্রমিকের প্রাণপ্রদীপ।
সেসময় শ্রমিকদের অভিযোগ থেকে জানা যায়, আগে থেকেই ফাটল ছিল ওই ভবনে। কিন্তু দুর্ঘটনার দিন হরতাল থাকাতেও কাজে আনা হয়েছিল শ্রমিকদের। ঝুঁকিপূর্ণ ওই ভবনে ছিল বিশাল আকৃতির জেনোরেটর। আর একসঙ্গে কাজ করতেন অন্তত সাড়ে তিন হাজার শ্রমিক।
ভবন ধসের চার বছর পার হলেও এখনও অনেক নিহত শ্রমিকদের স্বজন ও আহত শ্রমিকরা পায়নি প্রয়োজনী সহায়তা ও আর্থিক ক্ষতিপূরণ। যার ফলে অনেক আহত শ্রমিক অর্থাভাবে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবা নিয়ে আজও ফিরতে পারেনি স্বাভাবিক জীবনে।
শনিবার (২২ এপ্রিল) যুক্তরাজ্যভিত্তিক দাতা সংস্থা অ্যাকশনএইড জানিয়েছে, রানা প্লাজা ধসে ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের মধ্যে ৪২ দশমিক ৪ শতাংশ এখনও বেকার রয়েছেন।
রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির পর দেশ-বিদেশে আলোচনায় আসে বাংলাদেশের পোশাক কারখানার মান ও শ্রমিকের কর্মপরিবেশ। ওই বছর থেকেই সরকার, উদ্যোক্তা, শ্রমিক এবং বিদেশি বিভিন্ন সংস্থা সমন্বিতভাবে এ খাতের সংস্কারের উদ্যোগ নেয়।
প্রাথমিকভাবে সাড়ে তিন হাজার কারখানার মান উন্নয়ন ও শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিয়ে কাজ শুরু করে অ্যাকর্ড, এলাইন্স ও এনআই। কারখানাগুলো পরিদর্শন শেষে এই তিন সংস্থা বিভিন্ন ধরনের সাড়ে ৭৪ হাজার সমস্যা চিহ্নিত করে।
গত চার বছরে সমাধান হয়েছে ৩২ হাজার সমস্যার। ২০১৮ সালের মধ্যে অবশিষ্টগুলো শেষ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। জোর দেওয়া হয়েছে ভবনের অবকাঠামো, অগ্নি নিরাপত্তা এবং বিদ্যুৎজনিত দুর্ঘটনা।