দেশের কর্মস্থল এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি বন্ধে এখনো কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি বলে একটি জরিপ শেষে জানিয়েছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা অ্যাকশন এইড।
২০০৯ সালে হাইকোর্ট কর্মস্থলে এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি বন্ধে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে কমিটি গঠন করাসহ বিভিন্ন ব্যবস্থা নেয়ার গাইডলাইন দিয়েছিল।
অ্যাকশন এইড বলছে, বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানেই এই কমিটি গঠন করা হয়নি। আর যেসব জায়গায় করা হয়েছে, তা হয় অকার্যকর অথবা শিক্ষার্থীরা সেসব সম্পর্কে একেবারেই জানে না।
এই দুটি ঘটনার প্রেক্ষাপটে সে সময় শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদের মুখে বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন নিপীড়ন প্রতিরোধ কমিটি তৈরির ব্যাপারে জনমত গড়ে ওঠে।
এ অবস্থায় ২০০৮ সালে বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির দায়ের করা এক রিট পিটিশনের প্রেক্ষিতে, ২০০৯ সালে হাইকোর্ট কর্মস্থলে এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি বন্ধে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে কমিটি গঠন করাসহ বিভিন্ন ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশনা দিয়েছিল।
কিন্তু ন’বছর পার হলেও এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়সহ প্রতিষ্ঠানগুলো কতটা এগিয়েছে?
কথা বলেছিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে। যদিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১২ সালের শেষে পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটি গঠন করা হয়, কিন্তু শিক্ষার্থীদের অনেকেই সেসম্পর্কে অবহিত নন।
একজন বলছিলেন, ‘বন্ধুদের সঙ্গে যাচ্ছিলাম, এমন সময় ডাকসুর সামনে আমাকে একজন খারাপ কমেন্ট করে। কিন্তু আমি কাকে নালিশ করব, জানি না।’
আরেকজন বলেন, ‘কমিটি আছে জানি। হয় টিএসসিতে বা কলা ভবনের মনোবিজ্ঞান বিভাগের পাশে, কোথাও আছে হয়তো।’
অন্য একজন বলছিলেন ‘আমার বন্ধুর সাথে ঘটেছিল একটা ঘটনা, কিন্তু সে এতোই আপসেট ছিল, কাউকে বলতে পারেনি। আমাদের সঙ্গে শুধু কেঁদেছে, কিন্তু কাউকে কিছু বলেনি।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটির কোন আলাদা অফিস নেই। নেই ফ্যাকাল্টি বিভাগ বা হলেও শিক্ষার্থীদের অভিযোগ জানানোর ব্যবস্থাও।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য এবং যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটির প্রধান অধ্যাপক নাসরিন আহমাদ বলেন, গত পাঁচ বছরে তারা পাঁচ থেকে ছয়টি অভিযোগ পেয়েছেন।
‘আমাদের কাছে এই কয় বছরে পাঁচ কি ছয়টি অভিযোগ এসেছে, সবগুলোই সিরিয়াস। আর আমাদের কাছে যা অভিযোগ আসে, সেগুলো পড়ে থাকে না। ব্যবস্থা নেওয়া হয়’, বলেন তিনি।
বাংলাদেশের প্রায় সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ধরণের কমিটি থাকলেও, সবগুলোর অবস্থা প্রায় একই রকমের। অন্যদিকে, বর্তমানে বাংলাদেশে আছে প্রায় ৮৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। তার মধ্যে অল্প কয়েকটিতে এ ধরণের কমিটি রয়েছে।
স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশে এই কমিটি গঠন করা হয়েছে ২০০৯ সালে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে গিয়ে দেখা গেল শিক্ষার্থীরা তো নয়ই, অনেক শিক্ষকও এ কমিটির কথা জানেন না।
তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক নাওজিয়া ইয়াসমিন বলছিলেন, শিক্ষার্থীরা অনেক সময় অভিযোগ করতে আসেও না।
‘নয় বছরে একটি মাত্র অভিযোগ পেয়েছি। কিন্তু হয় কি, কেউ অভিযোগ করতে আসে না। এটা একটু সেনসিটিভ ইস্যু তো অনেকে আসে না, আমাদের ঐ মাইন্ডসেটটাই নাই।’
আর বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা অ্যাকশন এইডের এক সাম্প্রতিক জরিপেও উঠে এসেছে এ ধরণের চিত্রই।
যৌন হয়রানি থেকে বাঁচতে ঢাকায় নারীর ব্যাগে ছুরি
সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান, উন্নয়ন সংস্থা, পোশাক কারখানা এবং সংবাদ মাধ্যম কর্মীদের ওপর জরিপ চালায় সংস্থাটি।
দেখা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮৪ শতাংশ শিক্ষার্থী যৌন হয়রানি প্রতিরোধ সংক্রান্ত কোন কমিটির কথা জানেন না। ৮৭ শতাংশ শিক্ষার্থীরা সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনা সম্পর্কে জানেন না।
কর্মক্ষেত্রে এই হার ৬৪.৫ শতাংশ। সংস্থাটির বাংলাদেশ প্রতিনিধি ফারাহ কবীর ব্যাখ্যা করছেন তার পেছনের কারণগুলো সম্পর্কে।
‘আদালত নির্দেশনা দিয়ে দিয়েছে, সেটা বাস্তবায়ন তো করতে হবে। সেজন্য যেসব পদক্ষেপ নিতে হয়, তা নেয়া হয়নি। এটা আরো হয়নি কারণ এ নিয়ে জবাবদিহিতা নেই। বাধ্যবাধকতা থাকতে হবে, ফলোআপ থাকতে হবে।’ সূত্র: বিবিসি বাংলা