আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডাব্লিউ) বলেছে, সৌদি সরকার ক্ষমতা সুসংহত করার লক্ষ্যেই কেবল রাজপুত্র, মন্ত্রী ও ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ধরপাকড় অভিযান চালাচ্ছে।
সংস্থাটির মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক পরিচালক সারা লিহ উইটসন বুধবার নিউ ইয়র্কে বলেন, সৌদি আরবে রাতের অন্ধকারে হঠাৎ করে দুর্নীতি বিরোধী একটি সংস্থা গঠন করা হলো এবং সঙ্গে সঙ্গে একদল প্রিন্স, বর্তমান ও সাবেক মন্ত্রী, পদস্থ কর্মকর্তা এবং বিশিষ্ট ব্যবসায়ীকে আটক করা হলো। এ ঘটনা দেশটির মানবাধিকার পরিস্থিতি সম্পর্কে উদ্বেগ বাড়িয়ে দিয়েছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
এইচআরডাব্লিউ আরো বলেছে, সৌদি সরকারকে অবিলম্বে আটক ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে নেয়া আইনগত ব্যবস্থা প্রকাশ্যে ঘোষণা করতে হবে এবং তারা যাতে সব রকম আইনি সহায়তা পায় সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।
এসব বিশিষ্ট ব্যক্তিকে আটকের কারণ হিসেবে সৌদি কর্মকর্তারা দুর্নীতির যে অভিযোগ উত্থাপন করেছেন সে সম্পর্কে সারা উইটসন বলেন, তারা সত্যি সত্যি দুর্নীতি করে থাকলেও সে সংক্রান্ত তদন্ত ও গ্রেপ্তার বিচার বিভাগের পক্ষ থেকে হওয়া উচিত। এ ছাড়া, গণহারে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার করে তাদেরকে বিলাসবহুল হোটেলে রাখারও সমালোচনা করেন তিনি।
সম্প্রতি সৌদি রাজা সালমান নিজের ছেলে যুবরাজ মোহাম্মাদ বিন সালমানকে দুর্নীতি দমন কমিটির প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেন। নিয়োগ পাওয়ার পরপরই ৪ নভেম্বর রাতে সৌদি আরবের ন্যাশনাল গার্ড বাহিনীর প্রধানসহ বহু প্রিন্স, পদস্থ কর্মকর্তা, বর্তমান ও সাবেক মন্ত্রী এবং ব্যবসায়ীকে আটক করেন সালমান। আটক ব্যক্তিদেরকে একটি বিলাসবহুল হোটেলে অন্তরীণ রাখা হয়েছে।
সৌদি আরবের ৩২ বছর বয়সি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান দুই বছর আগে যখন ক্ষমতায় বসেন, তখন অনেকে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, তার হাত ধরে শিগগিরই আরো পরিবর্তন আসছে। ৪ নভেম্বরের ঘটনা শুধু দ্রুত পরিবর্তনেরই নয়, এ যেন ভূমিকম্পের মতো সব নাড়িয়ে দিল, সৌদি সীমান্ত ছাড়িয়ে যা মধ্যপ্রাচ্যেও অনুভূত হয়েছে।
২৪ ঘণ্টার এই নাটকীয় ও উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতি শুরু হয় শনিবার দুপুরে, যখন হত্যার শিকার হওয়ার আশঙ্কায় ও নিজ দেশের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার জন্য ইরানকে দায়ী করে সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদে পদত্যাগের ঘোষণা দেন লেবাননের প্রধানমন্ত্রী সাদ হারিরি।
এর কয়েক ঘণ্টা পর সৌদি আরবের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা জানায়, ইয়েমেন থেকে ছোঁড়া একটি বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র রিয়াদে বিমানবন্দরের কাছে আকাশে ধ্বংস করেছে সৌদি বাহিনী। ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংসের সময়ের বিস্ফোরণের ছবি যেমন মধ্যপ্রাচ্যের টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে, তেমনি আসতে থাকে একের পর এক নাটকীয় খবর।
খবর হলো- যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের নেতৃত্বাধীন দুর্নীতিবিরোধী কমিটি সৌদি আরবের প্রভাবশালী কয়েকজন রাজপুত্র, বর্তমান-প্রাক্তন মন্ত্রী ও ব্যবসায়ীদের আটক করেছে।
শনিবার রাতে সৌদি আরবে দুর্নীতিবিরোধী এ সংস্থা গঠন করা হয় এবং এর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে অভিযান চালিয়ে ১১ জন প্রিন্স ও সাবেক এবং বর্তমান ৩০ জন মন্ত্রীকে আটক করা হয়।
এমনকি দুর্নীতির অভিযোগে আটক সৌদি প্রিন্স ও ব্যবসায়ীদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দেশটির সরকার।
সৌদি সরকারি কর্মকর্তারা নিশ্চিত করেছেন, আটক ব্যক্তিদেরকে বিশেষ কোনো সুবিধা দেয়া হবে না এবং আইন অনুযায়ী তাদের মামলা চলবে।
সৌদি আরবের সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল কমিউনিকেশন জানিয়েছে, জব্দ সেসব ব্যাংক অ্যাকাউন্টের সঙ্গে দুর্নীতির সম্পর্ক পাওয়া যাবে সেগুলো থেকে অর্থ নিয়ে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেয়া হবে।
অর্থনৈতিক সংস্কারের নামে যুবরাজ মুহাম্মাদ বিন সালমান এসব অভিযান চালাচ্ছেন। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, সৌদি আরবের রাজা হওয়ার পথে সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বীদেরকে আটক করে নিজের পথ পরিষ্কার করছেন মুহাম্মাদ বিন সালমান।
বিশ্লেষকরা আরো বলছেন, এসব ঘটনা মধ্যপ্রাচ্যের সংকটাপন্ন ইতিহাসে নতুন এক সাংঘর্ষিক সময়ের জন্ম দিল। যার উৎপত্তি চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে কয়েক বছর ধরে চলা বেনামি যুদ্ধ থেকে। দুই দেশের সংঘাতের ফলে মধ্যপ্রাচ্যে নতুন রাজনৈতিক শক্তি জোট আবির্ভাবের হুমকি তৈরি হয়েছে। এরই মধ্যে কাতারকে একঘরে করে ইরানের বিরুদ্ধে শক্তি প্রদর্শন শুরু করেছে সৌদি আরব ও তার ঘনিষ্ট মিত্ররা।
গত শুক্রবার ইরাক ও সিরিয়ায় জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের (আইএস) সবশেষ ঘাঁটির পতন হয় এবং আইএসের খিলাফত ঘোষণার পর থেকে এ পর্যন্ত বিষয়টিকে জঙ্গিবিরোধী অভিযানের চূড়ান্ত বিজয় হিসেবে দেখা হচ্ছে। আইএসের এই পরাজয়ের পরদিনই মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো নিজ নিজ অ্যাজেন্ডা সামনে আনলো।
লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের অধ্যাপক ফাওয়াজ জার্জেস বলেছেন, আমি মনে করি, ‘তথাকথিত ইসলামিক স্টেটের (আইএস) পতন মানে সত্যিই তা ভূকৌশলগত সংঘাতের সমাপ্তি নয়।’ তিনি আরো বলেন, অন্যদিকে, তথাকথিত খিলাফতের অবসানের ফরে প্রকৃতপক্ষে ওই অঞ্চলে ইরানের নেতৃত্বাধীন ইরানপন্থি সিরিয়া ও হিজবুল্লাহ-নিয়ন্ত্রিত অঞ্চল এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ মধ্যপ্রাচ্যের অন্যদের মধ্যে ভূকৌশলগত সংঘর্ষ নিয়ে উত্তেজনা আরো বেড়ে যাবে।’