ঐতিহাসিক প্যালেস্টাইনে একটি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি সম্বলিত ‘বেলফোর’ ঘোষণার জন্য ব্রিটেনকে ক্ষমা চাইতে বলেছেন ফিলিস্তিনি প্রধানমন্ত্রী রামী হামদাল্লাহ।
আসছে সপ্তাহে ‘বেলফোর’ ঘোষণার শততম বার্ষিকী উপলক্ষ্যে রবিবার দখলকৃত ওয়েস্ট ব্যাংক সিটির নাবলুসে নতুন একটি পাবলিক স্কুলের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি এই দাবি করেন।
হামদুল্লাহ বলেন, ‘ব্রিটেনের অধীনে থাকা ফিলিস্তিনে তৎকালীন ব্রিটিশ পররাষ্ট্র সচিব আর্থার বেলফোরের তৈরি বেলফোর ঘোষণায় ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে ‘ঐতিহাসিক অবিচার’ করা হয়েছে।’
ইসরাইল রাষ্ট্র সৃষ্টিতে ১৯৪৮ সালে ঘোষিত বেলফোর শততম বার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষ্যে লন্ডনে একটি ডিনার পার্টির আয়োজন করে ব্রিটেন। এতে ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনজামিন নেতানিয়াহু এবং তার ব্রিটিশ কাইন্টারপার্ট থেরেসা মে অংশ নেন।
এজন্য ব্রিটেনের সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘এই ঘোষণার জন্য ব্রিটেনের উদযাপন করা উচিত নয়।’
হামদাল্লাহ বলেন, ‘এই উদযাপন আন্তর্জাতিক জনমত সম্পর্কে একটি চ্যালেঞ্জ। কেননা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আমাদের জাতীয় এই ইস্যুতে আমাদের প্রতি সমর্থন করেছে।’
প্যালেস্টাইনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস এবং তার সরকারের সদস্যরা অনেক দিন ধরেই বলেছিলেন যে তারা বেলফোর ঘোষণার জন্য ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে আইনি লড়াই করার জন্য প্রস্তুত আছেন। এই ঘোষণা ১৯৪৮ সালে ৭০০,০০০ জন ফিলিস্তিনিকে বাস্তুচ্যুত করেছিল।
বেলফোর ঘোষণা
বেলফোর ঘোষণা ছিল ফিলিস্তিনে ‘ইহুদিদের জন্য একটি জাতীয় আবাস’ প্রতিষ্ঠায় ১৯১৭ সালে যুক্তরাজ্যের করা একটি প্রতিশ্রুতি। তৎকালীন ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্থার বেলফোর এক চিঠিতে ব্রিটিশ ইহুদি নেতা লিওনেল ওয়াল্টার রথসচাইল্ডকে এই প্রতিশ্রুতি দেন। ফিলিস্তিন সে সময় অটোমান সাম্রাজ্যের অংশ এবং সংখ্যালঘু ইহুদি জনগোষ্ঠীর আবাস। ওই এলাকার জনসংখ্যার দিক থেকে তারা ছিল মাত্র ৯ শতাংশ।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪-১৯১৮) চলাকালীন ওই ঘোষণা আসে এবং অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর তা বাস্তবায়ন করা হবে বলে এতে শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়। তথাকথিত এই ম্যান্ডেট ব্যবস্থা মিত্রশক্তির দেশগুলো তৈরি করেছিল, যা ছিল আসলে ঔপনিবেশিকতা ও দখলদারিত্বের হালকা অবগুণ্ঠিত রূপ। বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি, অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি, অটোমান সাম্রাজ্য ও বুলগেরিয়া পরাজিত হওয়ার পর এই ম্যান্ডেটের বলে বিভিন্ন অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ মিত্রশক্তির করতলে আসে।
ফিলিস্তিনের ক্ষেত্রে ব্রিটিশ সরকারের প্রধানতম লক্ষ্য ছিল ইহুদিদের জন্য একটি ‘জাতীয় আবাস’ প্রতিষ্ঠা। এই লক্ষ্য বাস্তবায়ন শুরুর সঙ্গে সঙ্গে ব্রিটিশ সরকার ইউরোপজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ইহুদিদের ওই এলাকায় গিয়ে বসবাসের সুযোগ করে দিতে থাকে। ১৯২২ সাল থেকে ১৯৩৫ সালের মধ্যবর্তী সময়ে সেখানে ইহুদি জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ৯ শতাংশ থেকে বেড়ে প্রায় ২৭ শতাংশে গিয়ে দাঁড়ায়। যদিও বেলফোর ঘোষণায় ‘ফিলিস্তিনের ইহুদি নয় এমন জনগোষ্ঠীর নাগরিক ও ধর্মীয় অধিকার লঙ্ঘন করে এমন কিছু করা হবে না’ বলে প্রতিশ্রুতি থাকলেও ব্রিটিশ সরকার সেখানকার ইহুদি জনগোষ্ঠীকে স্বনিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় সরঞ্জাম সরবরাহ করতে থাকে।
এই ঘোষণা কেন বিতর্কিত?
প্রয়াত ফিলিস্তিনি-আমেরিকান শিক্ষাবিদ এডওয়ার্ড সাঈদের মতে, ইউরোপের বাইরের একটি এলাকার বিষয়ে ইউরোপীয় একটি শক্তি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। ওই এলাকার সংখ্যাগরিষ্ঠ অধিবাসীর উপস্থিতি এবং ইচ্ছা বড় আকারে উপেক্ষিত হয়েছিল।
বেলফোর ঘোষণা বিতর্কিত হওয়ার এটাই সর্বপ্রথম কারণ। দ্বিতীয়ত, প্রথম বিশ্বযুদ্ধকালীন বেলফোর ঘোষণার আগে ব্রিটিশরা ১৯১৫ সালে অটোমান সাম্রাজ্য থেকে আরবদের স্বাধীনতার প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু বেলফোর ঘোষণার অর্থ ছিল, ফিলিস্তিন ব্রিটিশ দখলদারিত্বের অধীনে চলে আসবে এবং ফিলিস্তিনি আরবরা কখনোই স্বাধীনতা পাবে না।
ইহুদি সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর হামলায় ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনি নাকবা বা প্রস্থানের ঘটনার মূল কারণ বলে মনে করা হয় বেলফোর ঘোষণাকে। যুক্তরাজ্যে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ওই গোষ্ঠীগুলো সাড়ে ৭ লাখেরও বেশি ফিলিস্তিনিকে মাতৃভূমি ত্যাগ করতে বাধ্য করে।
সূত্র: আনাদুলো এজেন্সি