মায়ানমারের রাখাইনে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর চলমান সহিংসতা ও গণহত্যার প্রতিবাদে রবিবার হোয়াইট হাউজের সামনে বিক্ষোভ করেছে শত শত মানুষ।
যুক্তরাষ্ট্রের সর্ববৃহৎ মুসলিম নাগরিক অধিকার ও অ্যাডভোকেসি সংস্থা আমেরিকান-ইসলামিক রিলেশনস কাউন্সিল (সিএইআইআর), ইসলামিক সোসাইটি অব নর্থ আমেরিকা (আইএসএনএ), মুসলিম আমেরিকান সোসাইটি (এমএএস) এবং আরো অনেকে এই বিক্ষোভে অংশ নেয়।
বিক্ষোভে অংশ নেয়া সিভিল সোসাইটির প্রতিনিধিরা রক্তপাত বন্ধ করার জন্য মায়ানমার কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ জানান। একই সঙ্গে রাখাইন রাজ্যে নিপীড়নের বিরুদ্ধে আরো কার্যকরভাবে কাজ করার পাশাপাশি মায়ানমার সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগের জন্য তারা ট্রাম্প প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানান।
মায়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলীয় রাখাইনে গত ২৫ আগস্ট থেকে দেশটির সেনাবাহিনী ও চরমপন্থী বৌদ্ধদের পৈশাচিক হত্যাজ্ঞ ও নির্মম নির্যাতনে ৬ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে বলে জাতিসংঘ জানিয়েছে।
সামরিক অভিযান ও বৌদ্ধ মিলিশিয়াদের অত্যাচারের মুখে বাঁচতে রাখাইন থেকে পালিয়ে আসছেন শরণার্থীরা। তারা শত শত নারী, পুরুষ ও শিশুদেরকে হত্যা করেছে। রোহিঙ্গদের বাড়িঘর লুটপাটের পর রোহিঙ্গা গ্রামগুলোতে আগুন দিয়েছে।
জাতিসংঘের গণহত্যা’র সংজ্ঞা উল্লেখ করে বিক্ষোভে অংম নেয়া ইউএস কাউন্সিল অফ মুসলিম অর্গানাইজেশন (ইউএসসিএমও) -এর মহাসচিব ওসামা জামাল বলেন, ‘এটি যদি গণহত্যা না হয়, তবে এটা কি আমি জানি না।’
নারী ও শিশুসহ রোহিঙ্গাদের হত্যা, গণধর্ষণ ও নিষ্ঠুর নির্যাতনের ডকুমেন্ট তৈরি করেছে জাতিসংঘ। এক প্রতিবেদনে জাতিসংঘের তদন্তকারীরা এই ধরনের লঙ্ঘনকে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে অভিহিত করেছে।
এডামস সেন্টারের সভাপতি সায়েদ মুখার জোর দেন যে, সহিংসতা বন্ধে যথাযথ প্রদক্ষেপ নেয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের মুসলমানদের উচিৎ মার্কিন সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা।
রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর কয়েক দশকের নির্যাতনের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এই গণহত্যা অতীতে সংঘটিত হয়েছে, আজও চলছে কিন্তু এটি আগামীতে হতে দেয়া উচিৎ নয়।’
বিক্ষোভেকারীরা মায়ানমারের কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে বিভিন্ন স্লোগান ও বিভিন্ন ব্যানার, ফেস্টুন বহন করেন। ‘রাখাইনে গণহত্যা বন্ধ কর’, ‘মায়ানমারে আমাদের ভাই ও বোনদেরকে বাঁচান’ ইত্যাদি স্লোগান দেন।
গত ২৫ আগস্ট মায়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গা নিধন অভিযান শুরুর পর প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের সংখ্যা ইতোমধ্যে ৬ লাখ ছাড়িয়ে গেছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ। তবে বেসরকারি হিসেবে এ সংখ্যা ৭ লাখেরও বেশি।
রোহিঙ্গাদের পালিয়ে আসার এ ধারা অব্যাহত থাকলে শরনার্থীর সংখ্যা ১০ লাখে পৌঁছাতে পারে বলে সতর্ক করেছে জাতিসংঘ। পরিস্থিতির ভয়াবহতায় জাতিসংঘ মনে করছে, মায়ানমার সেনাবাহিনী রাখাইনে জাতিগত নিধনে নেমেছে।
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় জেলা কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেয়া এসব রোহিঙ্গাদের মধ্যে ৯০ ভাগই হলো নারী, শিশু ও বৃদ্ধ। জাতিসংঘের সংস্থাগুলোর মতে, পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের মধ্যে শিশু রয়েছে শতকরা ৬০ ভাগ। এর মধ্যে ১১শ’র বেশি রোহিঙ্গা শিশু পরিবার ছাড়া অচেনাদের সঙ্গে পালিয়ে বাংলাদেশে এসেছে। আর এসব শিশুর চোখের সামনেই তাদের বাবা-মাকে গুলি ও জবাই করে হত্যা, মা-বোনদের ওপর যৌন নির্যাতন ও ঘর-বাড়িতে আগুন দেয়াসহ ইতিহাসের নৃশংসতম ঘটনাগুলো ঘটিয়েছে মায়ানমারের সেনারা।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল রোহিঙ্গা ইস্যুতে তাদের দেয়া সর্বশেষ প্রতিবেদনে রোহিঙ্গাদের ওপর মায়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতন, হত্যা, ধর্ষণসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের স্পষ্ট প্রমাণ হাজির করেছে। অ্যামনেস্টি বলছে, প্রত্যক্ষদর্শীদের জবানবন্দী, স্যাটেলাইট থেকে পাওয়া ছবি-ভিডিও এবং সব ধরনের তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে এ উপসংহারে উপনীত হওয়া যায় যে, ‘রাখাইনে হাজার হাজার রোহিঙ্গা নারী, পুরুষ ও শিশুদের ওপর পরিকল্পিত আক্রমণ চালানো হয়েছে এবং এটি মানবতার বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট অপরাধ।’
অভিযানের নামে মায়ানমারের সেনাবাহিনী খুন, ধর্ষণ, ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়া, কুপিয়ে হত্যাসহ বর্বরতার চূড়ান্ত সীমাও অতিক্রম করেছে বলে অভিযোগ নিউইয়র্ক ভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)। স্যাটেলাইট থেকে প্রাপ্ত ছবি বিশ্লেষণের মাধ্যমে সংস্থাটি বলেছে, ইতোমধ্যে প্রায় ২৮৮টি রোহিঙ্গা অধ্যুষিত গ্রাম পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। সংস্থাটি আরো জানায়, রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে মায়ানমারের সেনাবাহিনী মানবতাবিরোধী অপরাধ করছে।
সূত্র: আনাদুলো এজেন্সি