মায়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গাদের উপর বীভৎস নির্যাতনের জন্য দেশটির উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তাদের উপর শাস্তি হিসেবে নিষেধাজ্ঞার কথা চিন্তা করছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন।
ওয়াশিংটন, ইয়াঙ্গুন ও ইউরোপে কূটনীতিক ও সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাতকারের পর বার্তা সংস্থা রয়টার্স বলছে, সেখানকার সেনাবাহিনীর প্রধানসহ শীর্ষ জেনারেলদের উপর নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞা সম্পর্কে কথাবার্তা চলছে।
রবিবার প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মায়ানমারের শীর্ষ জেনারেলদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে অনেকগুলো বিষয় নিয়ে ভাবা হচ্ছে।
সূত্রের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, এ বিষয়ে এখনো কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। ওয়াশিংটন ও ব্রাসেলস এ জন্য আরো কিছু সময় নিতে পারে। রাখাইনে সহিংসতায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের জন্য সহায়তা বাড়ানোরও আলোচনা চলছে।
রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতন প্রসঙ্গে অং সান সু চির ভূমিকা নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে সোরগোল চলছে। এ নিয়ে সু চি চরম সমালোচনার মুখে পড়েছেন।
সু চি কি করতে পারতেন বা তার কি করা উচিত তা নিয়ে বিস্তর আলোচনার মাঝে রোহিঙ্গাদের উপর অত্যাচারে সেখানকার সেনাবাহিনীর ভূমিকার কথা যেন কিছুটা চাপা পরে যাচ্ছিলো।
সু চি নির্বাচনে জিতলেও মায়ানমারে এখনো বেশ প্রভাব রাখে দেশটির সেনাবাহিনী। দেশটির সংবিধানও সেনাবাহিনীর লেখা। পাঁচ দশকের বেশি সময় ধরে তারা ক্ষমতায় ছিল।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা ১৬ অক্টোবর মায়ানমার প্রসঙ্গে বৈঠকে বসবেন। যদিও তারা মনে করছেন না খুব শিগগির নিষেধাজ্ঞা বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেয়া হবে। নেদারল্যান্ডসের উন্নয়ন করপোরেশন বিষয়ক মন্ত্রী উলা টরনায়েস রয়টার্সকে বলেন, ‘মায়ানমারের সেনাবাহিনীর ওপর আরো চাপ প্রয়োগ করতে’ কোপেনহেগেন বিষয়টি আলোচ্যসূচিতে আনার চেষ্টা করছে।
মায়ানমার নিয়ে ট্রাম্প প্রশাসনের আলোচনা সম্পর্কে অবগত দুই মার্কিন কর্মকর্তা বলেন, মায়ানমারের সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইয়াংসহ কয়েকজন জেনারেল এবং রোহিঙ্গাদের গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়ার অভিযোগে রাখাইন বৌদ্ধ মিলিশিয়াদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিবেচনা চলছে।
নিষেধাজ্ঞা আরোপ হলে তাদের যুক্তরাষ্ট্রে থাকা সম্পদ জব্দ, যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণ নিষিদ্ধ এবং তাদের সঙ্গে আমেরিকানদের ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধসহ আরো কিছু বিষয় আসতে পারে। মার্কিন ওই দুই কর্মকর্তা বলেন, বিষয়টি নিয়ে ইউরোপ, জাপান ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সরকারের সঙ্গে আলোচনার কারণে ওয়াশিংটন এ বিষয়ে সাবধানতার সঙ্গে এগোচ্ছে।
ইয়াঙ্গুনে নিয়োজিত ইউরোপীয় এক জ্যেষ্ঠ কূটনীতিক বলেন, পশ্চিমা দেশগুলো এই সঙ্কট নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছে। তারা এ বিষয়ে একমত যে সমস্যার মূলে সেনাবাহিনী, বিশেষত কমান্ডার ইন চিফ, যাকে যেকোনো শাস্তিমূলক পদক্ষেপে ‘টার্গেট’ করা দরকার।
ইয়াঙ্গুনভিত্তিক কূটনীতিকেরা বলছেন, আলোচনার দ্বার খোলা রাখতে প্রথম পর্যায়ে শাস্তিমূলক পদক্ষেপ প্রতীকী হতে পারে। তারা উদাহরণ টেনে বলেন, গত বছর ব্রাসেলস, বার্লিন ও ভিয়েনা সফর করা মায়ানমার সেনাপ্রধানকে ইউরোপ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হতে পারে।
গত এক মাসে রাখাইনের মায়ানমারের সেনাবাহিনীর নিপীড়নের মুখে প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়ার পর পশ্চিমা নীতিনির্ধারকেরা এখন তাদের উপর কোন ধরনের ব্যবস্থা নেয়ার জন্য চাপের মুখে রয়েছেন।
মায়ানমার বাহিনীর অবরোধের মুখে গত ২৪ আগস্ট মধ্যরাতের পর রোহিঙ্গা যোদ্ধারা অন্তত ২৫টি পুলিশ স্টেশনে হামলা ও একটি সেনাক্যাম্পে প্রবেশের চেষ্টা চালায়। এতে মায়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ শুরু হয়।
এরপর রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে অভিযান শুরু করে মায়ানমারের সেনাবাহিনী। একের পর এক রোহিঙ্গা গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া হয়। মায়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে নির্বিচারে গুলি করে ও কুপিয়ে হত্যা এবং নারীদের গণধর্ষণের অভিযোগ উঠে। তাদের হত্যাযজ্ঞ থেকে রেহাই পায়নি বয়োবৃদ্ধ নারী এবং শিশুরাও। নিহত হয়েছেন প্রায় ৫ হাজার রোহিঙ্গা।
প্রাণ বাঁচাতে স্রোতের বেগে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আসতে শুরু করে। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনার (ইউএনএইচসিআর) এর কার্যালয় জানায়, গত এক মাসে ৫ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে।
সূত্র: রয়টার্স, বিবিসি