হিমালয়ের পাদদেশে ভারত ও চীনের মধ্যে অচলাবস্থা নিরসনের কারণে দু’দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে কয়েক সপ্তাহ ধরে চলা উত্তেজনা কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। তাই বলে ক্ষুদ্র রাষ্ট্র ভুটানের ওপর দুই দেশের প্রভাব বিস্তারের লড়াই কমবে ভাবার কারণ নেই।
বুধবার ভুটান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে দেয়া এক বিবৃতিতে দোকলাম অচলাবস্থা নিরসনকে স্বাগত জানানো হয়। বলা হয়, এই সেনা প্রত্যাহার তিন দেশের সীমান্তে শান্তি ও প্রশান্তি বজায় রাখতে সহায়ক হবে। ২৯ জুনের পর দোকলাম নিয়ে ভুটানের এটাই প্রথম সরকারি বিবৃতি। এর আগের বিবৃতিতে দোকলাম উপত্যকায় চীনের সড়ক নির্মাণকে ১৯৮৮ ও ১৯৯৮ সালের চুক্তির লঙ্ঘন বলে উল্লেখ করা হয়।
বেইজিং ভিত্তিক বিশ্লেষক রুপক সপকোটা বলেন, ভুটানের সুরে চীনের সঙ্গে আরো ঘনিষ্ঠ হওয়া ও সহযোগিতা বাড়ানোর আভাস পাওয়া যাচ্ছে। এ ব্যাপারে দেশটির সুর ক্রমেই চড়া হয়ে উঠছে। আগামীতে চীনের কাছাকাছি যেতে ভুটান আরো বেশি কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালাবে। কারণ, ভারতের চেয়ে ভুটানকে অনেক বেশি অর্থনৈতিক সাহায্য ও পর্যটন সহযোগিতা দেয়ার ক্ষমতা রাখে চীন।
অনেক ভুটানির মতে, এবারের অচলাবস্থা প্রমাণ করেছে চীনের সঙ্গে ভুটানের সীমান্ত সমস্যা মিটিয়ে ফেলা বেশি জরুরি। ভুটানের এক ফ্রিল্যান্স কলাম লেখক ইয়েশে দর্জি’র মতে, বিষয়টি অনন্তকাল ঝুলিয়ে রাখা আমাদের জন্য বোকামি হবে। তাই যত শিঘ্র সম্ভব তা মিটিয়ে ফেলা ভালো।
১৯৪৯ সালের এক চুক্তির কারণে ভূপরিবেষ্টিত হিমালায়ান দেশটি তার পররাষ্ট্র নীতির ব্যাপারে ভারতের দিক নির্দেশ মেনে চলতে বাধ্য হয়। ২০০৭ সালে চুক্তিটি নবায়ন করা হয়। ভুটানের সঙ্গে জাপানের কূটনৈতিক সম্পর্ক থাকলেও নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ স্থায়ী সদস্যের একটির সঙ্গেও সম্পর্ক নেই। তাই প্রতিবেশি হওয়ার পরও চীনের সঙ্গে তার আনুষ্ঠানিক কোন সম্পর্ক নেই।
নয়াদিল্লিতে ইন্সটিটিউট ফর ডিফেন্স স্টাডিজ-এর ইস্ট এশিয়া সেন্টারের প্রধান জগন্নাথ পান্ডে বলেন, ভুটান একটি স্বাধীন দেশ, তাই চীন দেশটির সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সমঝোতার মাধ্যমে সীমান্ত সমস্যা নিরসরন করবে, এটা কোন সমস্যা নয়। তবে, ভারতের স্বার্থের বিরুদ্ধে যায় এমন সমঝোতা সম্পর্কে তিনি সতর্ক করে দেন।
তিনি বলেন, মৈত্রি চুক্তির কারণে চীনের সঙ্গে কোন সীমান্ত চুক্তি করার আগে ভারতের সম্মতি নেয়া ভুটানের জন্য বাধ্যতামূলক বলে নয়াদিল্লি মনে করে।
সীমান্ত এলাকায় কোন কিছু করার আগে পরস্পরের সঙ্গে আলোচনা করবে বলে ২০১২ সালে ভারত ও চীনের মধ্যে চুক্তি হয়। চীন-ভুটান সীমান্তও এর অন্তর্ভুক্ত। তাই ভারতের দাবি না হলেও চীন ও ভুটানের মধ্যে সীমান্ত আলোচনায় ভারতের নিরাপত্তা স্বার্থ রয়েছে।
৭০ দিন ধরে চলা অচলাবস্থায় ভুটান তার পক্ষে ছিলো বলে ভারত দাবি করে। তবে, থিম্ফু ছিলো এ ব্যাপারে নীরব।
ভুটানের কিছু কিছু সমালোচক উদ্বেগ প্রকাশ করেন এই কথা বলে যে, দোকলামের মতো অজুুহাতে ভুটানকে দখল করে নেয়া ভারতের চূড়ান্ত লক্ষ্য। ভারত ১৯৭৫ সালে সিকিম রাজ্যটি দখল করে নিয়েছিলো। অবশ্য অনেক ভুটানি চীনকেও একই দৃষ্টিতে দেখেন। প্রতিবেশি তিব্বতকে চীন দখল করেছে বলে উদাহরণ দেন তারা।
চীনের সঙ্গে ভুটানের সীমান্ত নিয়ে ২৪ দফা আলোচনা হয়েছে। সবগুলো আলোচনাতেই ভারতের প্রতি বিশ্বস্ত থেকেছে হিমালয়ান দেশটি।
প্রভাবশালী ভুটানি পত্রিকা ‘দি ভুটানিজ’ এর সম্পাদক তেনজিং লামসাং বলেন, ভারতের নিরাপত্তা স্বার্থ দেখতে গিয়ে ভুটান অন্য দুটি এলাকা নিয়ে বিরোধে চীনের ‘উদার প্রস্তাব’ প্রত্যাখ্যান করেছে।
তবে অর্থনীতি নিয়ে ভারতের ব্যাপারে ভুটানের হতাশা দোকলাম বিরোধ থেকেও বড় প্রভাবশালি হিসেবে দেখা দিতে পারে বলে তেনজিং মনে করেন।
জলবিদ্যুৎ ভুটান ও ভারতের অর্থনৈতিক বন্ধনের প্রাণশক্তি। ভুটানের জিডিপি ২০% এখান থেকে আসে। উৎপাদিত বিদ্যুতের ৭০% ভারতে রফতানি হয়। সরকারের রাজস্ব আয়ের ৪০% আসে বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলো থেকে।
ভুটান আরো ১০,০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ভারতের সঙ্গে চুক্তি করেছে।
তেনজিং বলেন, ভারতে বিদ্যুৎ বিক্রির ওপর ভুটানের গোটা অর্থনীতি নির্ভরশীল। কিন্তু নয়াদিল্লি এখন বলছে ১০,০০০ মেগাওয়াটের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সম্ভব নয় এবং ভুটানের বিদ্যুতের দামও তারা কম দিচ্ছে। তাছাড়া, ভারতের সঙ্গে ভুটানের বাণিজ্য ঘাটতিও বিপুল।
সবমিলিয়ে ভারতের ওপর এই বিপুল নির্ভরশীলতা কমাতে ভুটানের সামনে চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি ছাড়া আর কোনো পথ নেই।
সূত্র: সাউথ এশিয়ান মনিটর