সাকিব আহসান,পীরগঞ্জ, ঠাকুরগাঁওঃ
ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জ উপজেলার শীতলপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সম্পদ আত্মসাৎ ও প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত লঙ্ঘনের ঘটনায় চাঞ্চল্য দেখা দিয়েছে। সরকারি বরাদ্দে নির্মাণকাজের জন্য বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে রাখা প্রায় ২০,০০০ ইট, টিন ও অন্যান্য সামগ্রী রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হওয়ার অভিযোগ উঠেছে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মধুসূদন রায় ও তৎকালীন স্কুল ম্যানেজিং কমিটির (এসএমসি) সদস্যদের বিরুদ্ধে।
২০২৪ সালের ৯ মে বিদ্যালয়ের এসএমসি সভায় পুরাতন টিনশেড ভবন ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সভায় সহসভাপতি হরেন্দ্রনাথ বাবু প্রস্তাব করেন, ভবনের ইট, টিন ও ব্যবহারযোগ্য সামগ্রী বিদ্যালয়ের ভেতর সংরক্ষণ করা হবে এবং ভবিষ্যতে এসব উপকরণ দিয়ে একটি সাইকেল গ্যারেজ ও অভিভাবকদের বসার জন্য গোলঘর নির্মাণ করা হবে। কিন্তু সভার সিদ্ধান্ত অমান্য করে বিপুল পরিমাণ ইট আত্মসাৎ করা হয়। স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন, কিছু ইট বিক্রি হয়েছে স্কুলসংলগ্ন বাসাবাড়িতে, আর বাকিগুলো অন্যত্র সরিয়ে ফেলা হয়েছে।
এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০২৫ সালের ২৯ অক্টোবর শীতলপুর গ্রামের একাধিক ব্যক্তি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) নিকট গণস্বাক্ষরিত লিখিত অভিযোগপত্র জমা দেন। অভিযোগপত্রটি ডাক বিভাগের মাধ্যমে প্রেরিত হয়, যার তিনটি পৃথক রেজিস্ট্রি নম্বর হলো — DL759386760BD, DL759386800BD, এবং DL759386756BD। এই অভিযোগে ১০ জন স্থানীয় নাগরিক স্বাক্ষর করেন, যাদের মধ্যে রয়েছেন মো. মকবুল হোসেন, আব্দুল হালিম, নুরআলম, নুর ইসলাম, আব্দুল করিম, মাহমুদ আলী প্রমুখ।
অভিযোগকারীদের ভাষায়, “বিদ্যালয় শুধু শিক্ষার কেন্দ্র নয়, এটি রাষ্ট্রের সম্পদ। অথচ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও কমিটির সদস্যরা দায়িত্ব ভুলে ব্যক্তিগত স্বার্থে সরকারি সম্পদ বিক্রি করেছেন।” তারা দাবি করেছেন, এটি শুধু দুর্নীতি নয় এটি সরকারি অর্থ ও জনআস্থার প্রতি প্রতারণা।
আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা বাংলাদেশ দণ্ডবিধি ১৮৬০ অনুযায়ী একাধিক ধারায় অপরাধ করেছেন।
ধারা ৪০৬ অনুসারে, বিশ্বাসভাজন কর্তৃক সম্পত্তি আত্মসাৎ ; সরকারি সম্পদ ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
ধারা ৪০৯ অনুসারে, সরকারি কর্মচারী বা ট্রাস্টি কর্তৃক আত্মসাৎ ; ট্রাস্টি হিসেবে দায়িত্বে থেকে আত্মসাৎ করলে তা গুরুতর অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়।
ধারা ৪২০ অনুসারে, প্রতারণা ও আর্থিক লাভের উদ্দেশ্যে সম্পত্তি বিক্রি করাও অপরাধ।
এছাড়া, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটি বিধিমালা ২০২১ অনুযায়ী, এসএমসি সদস্যরা বিদ্যালয়ের সম্পদ সংরক্ষণের জন্য সরাসরি দায়ী। সেই দায়িত্বে অবহেলা প্রশাসনিক অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে।
২০২৪ সালের ৫ আগস্টে তৎকালীন কমিটি বিলুপ্ত করে নতুন চার সদস্যবিশিষ্ট অ্যাডহক কমিটি গঠন করা হয়, যার সভাপতি এটিইও (ATEO) নাসিমুল বারী এবং সদস্য সচিব করা হয় প্রধান শিক্ষক মধুসূদন রায়কে। স্থানীয়দের অভিযোগ, নতুন কমিটিও আগের অনিয়ম ঢাকতে নীরব ভূমিকা পালন করছে।
স্থানীয় অভিভাবকরা প্রশাসনের প্রতি দাবি জানিয়েছেন, দ্রুত তদন্ত করে সংশ্লিষ্টদের বিচারের আওতায় আনা হোক। তারা আশঙ্কা করছেন, দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা না নিলে এই দুর্নীতির ধারা অন্য বিদ্যালয়েও ছড়িয়ে পড়বে।
একজন অভিযোগকারী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “শিক্ষক যদি চোর হয়, তাহলে ছাত্ররা শিখবে কী?”
শীতলপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এই ঘটনা শুধু একটি বিদ্যালয়ের ইট চুরির বিষয় নয়; এটি প্রশাসনিক দায়, নৈতিক পতন ও শিক্ষাক্ষেত্রে দুর্নীতির নগ্ন প্রতিচ্ছবি। তদন্তের স্বচ্ছতা ও দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণই পারে জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধার করতে। অন্যথায়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা আরও গভীর শিকড় গাঁড়বে যার দায় বহন করতে হবে পুরো সমাজকেই।