সাকিব আহসান,পীরগঞ্জ, ঠাকুরগাঁওঃ
ঠাকুরগাঁও জেলার পীরগঞ্জ উপজেলার মিত্রবাটি মৌজার একটি জমি এখন কেবল ব্যক্তিগত মালিকানা বিরোধের বিষয় নয়; এটি আইনের শাসন, আদালতের কর্তৃত্ব এবং স্থানীয় শান্তি–শৃঙ্খলার ওপর এক স্পষ্ট চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। জে এল নং–৮১, সি এস–৬৪ ও এস এ–৯৮ নং খতিয়ানভুক্ত ১৯১ নং দাগের ২০০ শতক জমির মধ্যে ১২.৫০ শতক বর্তমানে সহকারী জজ আদালত, ঠাকুরগাঁওয়ে দায়েরকৃত মোকদ্দমা নং–৩৪/২০২৪ অনুযায়ী সাবজুডিস অবস্থায় রয়েছে। বাদী মোঃ খোরশেদ আলম ও বিবাদী তৈমুর রহমানের মধ্যে চলমান এই মামলা আদালতের বিচারাধীন থাকা সত্ত্বেও বাস্তবে দেখা যাচ্ছে আইনকে পাশ কাটিয়ে স্বেচ্ছাচারী আচরণ ও অঘোষিত দখলদারিত্বের প্রবণতা।
মামলার প্রেক্ষাপটে বাদীপক্ষ দেওয়ানী কার্যবিধি আইন, ১৯০৮-এর আদেশ ৩৯ এর নিয়ম ১ ও ২ এবং ধারা ১৫১ অনুযায়ী অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার আবেদন করেন। এই ধারাগুলো আদালতকে ক্ষমতা দেয়—যদি কোনো সম্পত্তিতে অবৈধ দখল, ক্ষতি বা অবস্থার পরিবর্তনের আশঙ্কা থাকে, তবে আদালত স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে নিষেধাজ্ঞা জারি করতে পারেন। সেই আইনি ক্ষমতাবলে ২৭ মে ২০২৪ তারিখে আদালত কারণ দর্শানো নোটিশ জারি করেন, যেখানে একাধিক ব্যক্তির বিরুদ্ধে অবৈধ প্রবেশ (Illegal Trespass) ও ক্ষতিসাধনের অভিযোগ উত্থাপিত হয়।
কিন্তু আইনের কাগুজে নির্দেশনার সঙ্গে মাঠপর্যায়ের বাস্তবতার বিস্তর ফারাক। সাবজুডিস নীতিমালা অনুযায়ী যে সম্পত্তি আদালতে বিচারাধীন, সেখানে কোনো পক্ষই নতুন নির্মাণ, দখল, হস্তান্তর বা ব্যবহারের ধরন পরিবর্তন করতে পারে না। এটি শুধু দেওয়ানী কার্যবিধির মৌলিক নীতি নয়; বরং আইনের শাসনের একটি অপরিহার্য স্তম্ভ। আদালতের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করা দণ্ডবিধির দৃষ্টিতে আদালত অবমাননার শামিল, যা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। অথচ স্থানীয়দের অভিযোগ বাদী পক্ষই বারবার এই নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে পরিস্থিতি ঘোলাটে করছে।
এই স্বেচ্ছাচারী আচরণের সরাসরি ভুক্তভোগী হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। জমিটি কেন্দ্র করে চলাচলের পথ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, এমনকি ছোটখাটো সংঘর্ষের আশঙ্কাও তৈরি হয়েছে। একটি দেওয়ানী মামলা যেখানে আদালতের চার দেয়ালের মধ্যে নিষ্পত্তি হওয়ার কথা, সেখানে তা ধীরে ধীরে সামাজিক নৈরাজ্যের রূপ নিচ্ছে যার দায় কোনো একক পক্ষ এড়াতে পারে না।
আইনজ্ঞদের মতে, এ ধরনের পরিস্থিতিতে আদালতের আদেশ কঠোরভাবে বাস্তবায়নের পাশাপাশি দণ্ডবিধির ধারা ১৮৮ (আইনগত আদেশ অমান্য) প্রয়োগের সুযোগ রয়েছে। একই সঙ্গে দেওয়ানী কার্যবিধির অধীনে আদালত চাইলে পুলিশি সহায়তায় নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করতে পারেন। তবে শুধু দমনমূলক ব্যবস্থা নয়; বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি (ADR), সালিশ বা পারস্পরিক সমঝোতার উদ্যোগও জরুরি, যাতে মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত জনভোগান্তি কমে।
অন্যথায়, পীরগঞ্জের এই ভূমি বিরোধ একটি বিপজ্জনক নজির স্থাপন করবে যেখানে আদালতের আদেশ উপেক্ষা করেও শক্তি ও প্রভাবের জোরে বাস্তবতা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এটি কেবল একটি মামলার পরিণতি নয়; এটি আইনের প্রতি মানুষের আস্থার প্রশ্ন। আর সেই আস্থা ভেঙে পড়লে ক্ষতিগ্রস্ত হবে পুরো সমাজ।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.