সাকিব আহসান,পীরগঞ্জ, ঠাকুরগাঁও
ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জ উপজেলার ৭ নম্বর হাজীপুর ইউনিয়নে হাজীপুর মহাবিদ্যালয়ের নতুন ভবন নির্মাণকাজে যে অনিয়মের চিত্র উঠে এসেছে, তা শুধু প্রশাসনিক গাফিলতি নয় বরং এটি সরাসরি একাধিক আইন লঙ্ঘনের শামিল। সরকারি অর্থায়নে নির্মিত একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভবন যদি শুরু থেকেই মানহীন উপকরণ ও দায়িত্বহীন তদারকির মাধ্যমে গড়ে ওঠে, তবে সেটি জনস্বার্থ, শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদের জন্য ভয়াবহ হুমকি হয়ে দাঁড়ায়।
সরেজমিনে দেখা যায়, নির্মাণকাজে ব্যবহৃত বালুতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ জৈব পদার্থ রয়েছে। স্থানীয়ভাবে জানা গেছে, পার্শ্ববর্তী ঈদগাহ ময়দান সংলগ্ন ‘ছোট পুকুর’ নামক একটি পুকুর থেকে অনুমতি ছাড়াই বালু উত্তোলন করে তা ভবন নির্মাণে ব্যবহার করা হচ্ছে। এই কাজটি বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন, ২০১০ এর সরাসরি লঙ্ঘন। আইনটির ৪ ধারায় বলা হয়েছে, সরকার নির্ধারিত এলাকা ছাড়া কোথাও বালু উত্তোলন করা যাবে না এবং ১৫ ধারায় অবৈধ উত্তোলনের জন্য জরিমানা ও কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে।
এছাড়া, নির্মাণসামগ্রীর মান সংক্রান্ত বিষয়ে বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড (BNBC) অনুযায়ী ভিত্তি নির্মাণে ব্যবহৃত বালু অবশ্যই পরিষ্কার, পরীক্ষিত ও জৈব পদার্থমুক্ত হতে হবে। জৈব পদার্থযুক্ত বালু ভবনের কাঠামোগত শক্তি কমিয়ে দেয়, যা ভবিষ্যতে ফাটল, ধস কিংবা বড় ধরনের দুর্ঘটনার ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। এ ধরনের অবহেলা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জীবনের সঙ্গে সরাসরি খেলার শামিল।
অভিযোগ উঠেছে, হাজীপুর মহাবিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ জেসমিন আরা মুক্তি এবং উপসহকারী প্রকৌশলী অলক রায়ের নির্বিকার ভূমিকার সুযোগ নিয়ে মিস্ত্রি ফরমান আলী দায়সারাভাবে নির্মাণকাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। সরকারি প্রকল্পে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের এই নিষ্ক্রিয়তা দণ্ডবিধি, ১৮৬০ এর ১৬৬ ধারায় অপরাধ হিসেবে গণ্য হতে পারে, যেখানে সরকারি কর্মচারীর দায়িত্বে অবহেলা বা আইন অমান্য করার বিষয়ে শাস্তির বিধান রয়েছে। পাশাপাশি, যোগসাজশ ও অসদাচরণের প্রমাণ মিললে এটি দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪ এর আওতায় তদন্তযোগ্য অপরাধ।
ভাষ্য নেওয়ার জন্য ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি, যা জবাবদিহিতার অভাবকেই স্পষ্ট করে। অপরদিকে, নির্মাণকাজে যুক্ত মিস্ত্রি ফরমান আলীর উদ্ধত মন্তব্য,“নিউজ করেন, নিউজ করলে আমার পাবলিসিটি হবে”। যা প্রকল্প বাস্তবায়নে দায়িত্ববোধের চরম অভাবেরই প্রতিফলন।
সরকারি অর্থে নির্মিত কোনো প্রকল্পে এ ধরনের অনিয়ম সরকারি অর্থ অপচয় প্রতিরোধ আইন ও সরকারি ক্রয় বিধিমালা (PPR)–এর মূল চেতনারও পরিপন্থী। প্রশ্ন উঠছে—যদি ভবিষ্যতে এই ভবনে কোনো দুর্ঘটনা ঘটে, তবে তার দায়ভার কে নেবে?
এই প্রেক্ষাপটে স্থানীয় প্রশাসন, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর (EED) ও সংশ্লিষ্ট দপ্তরের অবিলম্বে হস্তক্ষেপ অত্যন্ত জরুরি। নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে দায়ীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ না করা হলে, হাজীপুর মহাবিদ্যালয়ের এই ভবন অনিয়মের এক স্থায়ী স্মারক হয়ে থাকবে আর ঝুঁকির মুখে পড়বে আগামী প্রজন্মের শিক্ষার্থীরা।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.