জিল্লুর রহমান পলাশ, গাইবান্ধাঃ গাইবান্ধার সাদুল্লাপুর উপজেলার দামোদরপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাময়িক বরখাস্ত চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলম এখনো নিয়মিত অফিস করছেন। এমন অভিযোগ উঠেছে।
স্থানীয়দের দাবী, বরখাস্তের পরও তিনি ‘চেয়ার দখল করে’ পরিষদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। ইউপি সদস্যদের অভিযোগ ওয়ারিশ সনদ, ট্রেড লাইসেন্স ও প্রকল্প সংক্রান্ত বিভিন্ন কাগজপত্রেও তিনি অবৈধভাবে স্বাক্ষর করে যাচ্ছেন।
ফ্যাসিস্ট নিষিদ্ধ যুবলীগের সক্রিয় নেতা হিসেবে পরিচিত জাহাঙ্গীরের এমন আচরণে ক্ষুব্ধ পরিষদের সদস্য থেকে শুরু করে সাধারণ এলাকাবাসী। রাজনৈতিক দলগুলোর স্থানীয় নেতারাও তার দাপটপূর্ণ অবস্থানের কারণে তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন।
সম্প্রতি জাহাঙ্গীর আলমকে চূড়ান্তভাবে অপসারণের জন্য কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়ে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে ১০ কার্যদিবসের মধ্যে জবাব দিতে বলা হয়েছে। এরআগে অবৈধ ও জালিয়াতিপূর্ণ জন্মনিবন্ধন ইস্যুতে বড় ধরনের দুর্নীতির প্রমাণ মিললে তাকে সাময়িক বরখাস্ত করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। গত মঙ্গলবার (১১ নভেম্বর) স্থানীয় সরকার বিভাগ ইউপি-১ শাখার উপসচিব মো. নুরে আলম স্বাক্ষরিত ওই প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়। একই ব্যক্তিকে একাধিকবার ভিন্ন পিতা-মাতা দেখিয়ে ২০টি ভুয়া জন্ম নিবন্ধন ইস্যু করা হয়েছে এবং (বিডিআরআইএস) সিস্টেমের ইউজার আইডি-পাসওয়ার্ড অবৈধভাবে অন্যের কাছে হস্তান্তরের মাধ্যমে সিস্টেমে গুরুতর নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি করা হয়েছে।
তবে অভিযোগ উঠেছে, বরখাস্তের পরও জাহাঙ্গীর প্রতিদিন পরিষদে বসে বিভিন্ন নথিতে স্বাক্ষর করছেন এবং পরিষদের কর্মকান্ড নিজের মতো করে পরিচালনা করছেন। ইউপি সদস্যদের দাবী উন্নয়ন প্রকল্পের বরাদ্দে নয়-ছয়, ভাতা ও সেবার নামে চাঁদাবাজি এবং ট্যাক্স আদায়ের অর্থ আত্মসাত তার দীর্ঘদিনের অনিয়ম-দুর্নীতির অংশ। এসব বিষয়ে নতুন করে লিখিত অভিযোগ দাখিলেরও প্রস্তুতি নিচ্ছেন ভুক্তভোগীসহ স্থানীয়রা।
এ বিষয়ে প্রশাসন ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। দ্রুতই দামোদরপুর ইউনিয়নে প্যানেল চেয়ারম্যানকে দায়িত্ব দেওয়ার প্রজ্ঞাপন জারি হবে। বরখাস্তের পরও যদি জাহাঙ্গীর দাপ্তরিক কার্যক্রম পরিচালনা করেন, তাহলে তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বিষয়টি নিয়ে বৃহস্পতিবার রাতে মুঠোফোনে কথা হলে স্থানীয় সরকার বিভাগ, ইউপি-১ শাখার উপসচিব মো. নুরে আলম বলেন, ‘চেয়ারম্যান বরখাস্তের প্রজ্ঞাপন ও কারণ দর্শানোর নোটিশ পাঠানো হয়েছে। প্রজ্ঞাপন ইতোমধ্যে জেলা প্রশাসকের কাছে পৌঁছেছে, নিয়ম অনুযায়ী তিনিই ব্যবস্থা নেবেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘সাময়িক বরখাস্তের পর কোনোমতেই চেয়ারম্যান হিসেবে পরিষদের নথিতে স্বাক্ষর বা দাপ্তরিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা তার নেই। এ বিষয়ে লিখিত অভিযোগ জেলা প্রশাসকের কাছে গেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
এদিকে; বরখাস্তের পরও পরিষদে নিয়মিত ওঠাবসা এবং দায়িত্ব পালন করায় স্থানীয়দের মাঝে তীব্র ক্ষোভ ও উত্তেজনা তৈরি হয়েছে। এলাকাবাসীর অভিযোগ জাহাঙ্গীরের একাধিক অনিয়ম, দুর্নীতি ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড থাকা সত্ত্বেও তিনি দাপট দেখিয়ে পরিষদ চালাচ্ছেন। তারা বলছেন, স্থানীয়ভাবে নিষিদ্ধ ফ্যাসিস্ট দলের নেতা ও দামোদরপুর ইউনিয়ন যুবলীগের আহ্বায়ক ছিলেন জাহাঙ্গীর। তার বিরুদ্ধে পুনর্বাসনসহ সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পে দুর্নীতি, ভাতা ইস্যুতে চাঁদাবাজি, পছন্দের লোকজন নিয়ে অপকর্মের নেটওয়ার্ক গড়ে তোলাসহ অনেক অভিযোগ রয়েছে।
সম্প্রতি এসব অনিয়ম-দুর্নীতির প্রতিবাদে স্থানীয়রা মানববন্ধনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও চেয়ারম্যানের লোকজনের চাপ ও হুমকিতে তা অনুষ্ঠিত হয়নি। এর আগে তার অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে ইউপি সদস্য আব্দুল লতিফ যেসব অভিযোগ ইউএনওর কাছে জমা দিয়েছিলেন, সেগুলোর তদন্তের উদ্যোগ আজও নেয়া হয়নি বলে অভিযোগ করেন এলাকাবাসী।
যদিও আগে থেকেই জাহাঙ্গীরের অনিয়ম-দুর্নীতি ও সুবিধার নামে টাকা আদায়ের অভিযোগ স্থানীয়দের মুখে মুখে ছিল। এতদিন এ বিষয়ে তারা চুপ থাকলেও বরখাস্তের খবর প্রকাশের পর ভুক্তভোগীসহ অনেকে মুখ খুলতে শুরু করেছেন। এরেইমধ্যে সরেজমিন অনুসন্ধানে ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে উন্নয়ন প্রকল্পে সরকারি বরাদ্দে নয়-ছয়, অনিয়ম-দুর্নীতি ও হয়রানির ভিডিও প্রমাণ প্রতিবেদকের হাতে এসেছে।
অন্যদিকে; দীর্ঘদিনের দুর্নীতির চিত্র প্রকাশ্যে আসার পর স্থানীয় রাজনৈতিক দলের নেতারাও ক্ষোভ প্রকাশ করে জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা ও গ্রেফতারের দাবী জানিয়েছেন। তাদের অভিযোগ, চেয়ারম্যান হওয়ার পর থেকেই জাহাঙ্গীর ঘনিষ্ঠ লোকজন নিয়ে একটি সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন এবং বিচার–শালিস থেকে শুরু করে বিভিন্ন সেবার নামে টাকা আদায় করেন। নেতারা দুর্নীতি ও অপকর্মের দ্রুত তদন্ত, ব্যবস্থা গ্রহণ এবং জাহাঙ্গীরকে গ্রেফতারের দাবী জানান। স্থানীয়দের আশঙ্কা, দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে জনরোষ যে কোনো সময় বিস্ফোরিত হতে পারে।
উল্লেখ্য; চেয়ারম্যান হওয়ার আগেও জাহাঙ্গীর অনিয়ম ও দুর্নীতির ঘটনায় আলোচিত ছিলেন। ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্পে দুর্নীতির দায়ে বরখাস্ত হওয়া এই যুবলীগ নেতা ২০২২ সালের নভেম্বরে দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.