সাকিব আহসান,পীরগঞ্জ, ঠাকুরগাঁওঃ
অগ্রহায়ণ,বাংলার কৃষিপঞ্জির সবচেয়ে আশাব্যঞ্জক মাসগুলোর একটি। নতুন ধানের সুবাসে চারদিক যখন প্রাণ ফিরে পায়, তখন গ্রামীণ সমাজে জন্ম নেয় কৃতজ্ঞতার এক বিশেষ আবহ। সেই ঋতুচক্রের অংশ হিসেবেই লাহিড়ী পাড়িয়া, কানাভিটা গ্রামের দেবাড়ু গাইন গোষ্ঠী এসেছেন পীরগঞ্জের সাগুনী গ্রামে অনুষ্ঠিত হলো মা মনসা দেবীর দিনব্যাপী পূজা। দেবাড়ু গাইনের উদ্যোগে আয়োজিত এই পূজা শুধু ধর্মীয় আচার নয়; এটি ছিল আশা, ফসল, সমাজ ও সংস্কারের মিলিত এক উৎসব।
নবান্ন শেষে গ্রামবাসীর মনে থাকে বছরের শ্রমের পরিতৃপ্তি,আর সেই পরিতৃপ্তির মাঝেই মা মনসার উদ্দেশে নিবেদন করা হয় অনুষঙ্গ, সঙ্গীত, প্রদীপ ও মানসিক প্রার্থনা। লোকবিশ্বাসে মনসা দেবী কেবল নাগদেবী নন, তিনিই প্রত্যাশা পূরণের রক্ষাকবচ। কৃষকের ঘরে নতুন ধানের গোলা ভরার সঙ্গে যেভাবে নতুন স্বপ্ন জন্ম নেয়, ঠিক তেমনই পূজার প্রতিটি আচার মনে করিয়ে দেয় মঙ্গল কামনা মানেই শেকড়ের প্রতি শ্রদ্ধা।
এই পূজার সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক ছিল এর সাংস্কৃতিক সংগঠন। ইন্সট্রুমেন্টাল পরিবেশনায় নেতৃত্ব দেন কল্যাশ শর্মা, দোলগবিন্দ রায়, মাধব চন্দ্র বর্মণ ও সাগর চন্দ্র বর্মণ। তাঁদের তন্ত্রী-বীণা, ঢোল ও বাঁশির সমন্বয়ে তৈরি হয়েছিল এক অনাবিল আঞ্চলিক সুরমঞ্চ যা উৎসবটিকে আরও প্রাণবন্ত করে তোলে। প্রদীপ চন্দ্র রায়ের মনোমুগ্ধকর উপস্থাপনা অনুষ্ঠানে ছড়িয়ে দেয় ঐতিহ্যবাহী ভক্তির আবহ।
দেবাড়ু গাইনের সার্বিক ব্যবস্থাপনায় দিনব্যাপী চলা এই পূজায় অংশ নেন গ্রামের প্রবীণ, তরুণ, নারী ও শিশু অর্থাৎ এক সাম্যবাদী সামাজিক মিলনমেলা তৈরি হয় স্বতঃস্ফূর্তভাবে। ধর্মাচারে বিশ্বাসী মানুষ যেমন প্রার্থনায় মন দেন, তেমনি সংস্কৃতি ও সামাজিক ঐক্যকেও এই আয়োজনের কেন্দ্রবিন্দুতে দেখা গেছে। এটি মনে করিয়ে দেয়, মনসা পূজা গ্রামবাংলায় শুধু বিপদমুক্তির আনুষ্ঠানিকতা নয়; এটি হলো সম্পর্ক জোড়া লাগানোর, সুখ-দুঃখ ভাগাভাগির এবং শিকড়ের সঙ্গে মানুষের সংযোগ পুনর্গঠনের একটি পরম ঐতিহ্য।
অগ্রহায়ণের রোদ, নবান্নের গন্ধ আর সমাজের সম্মিলিত আস্থায় তৈরি এই দিনব্যাপী মনসা পূজা তাই শুধু একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়,এটি ছিল সংস্কৃতি, আশা ও মানবিকতার এক নিবিড় উৎসব।