চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান দমনে মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলার পূর্ণাঙ্গ বৃত্তান্ত
চব্বিশের জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থান দমনে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে দায়ের করা আইসিটি বিডি কেস নম্বর ২/২০২৫-এর রায় ঘোষণা করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। চিফ প্রসিকিউটর বনাম শেখ হাসিনা ও অন্যান্য শিরোনামের এ মামলায় আদালত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে মৃত্যুদণ্ড এবং সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেন।
অভিযোগ গঠন থেকে রায়—ঘটনাপুঞ্জি
২০২৪ সালের ১৪ আগস্ট ও ২৯ অক্টোবর অভিযোগ পাওয়ার পর তদন্ত কার্যক্রম শুরু হয়। মিস কেস নং ০২/২০২৪ করা হয় ১৬ অক্টোবর। একই দিনে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে এবং পরদিন অন্যান্য আসামির বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়। সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে গত ১৬ মার্চ গ্রেফতার দেখানো হয়।
তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল হয় চলতি বছরের ১২ মে এবং ১ জুন দাখিল হয় ফরমাল চার্জ। ১৪ খণ্ডে প্রায় ১০ হাজার পৃষ্ঠার দালিলিক সাক্ষ্য, ৯৩টি প্রদর্শনী এবং ৩২টি বস্তুগত প্রমাণ আদালতে উপস্থাপন করে প্রসিকিউশন। পত্রপত্রিকা, অনুসন্ধান প্রতিবেদন, ভিডিও-অডিও রেকর্ডিং, বুলেট-পিলেট, পোস্টমর্টেম ও সুরতহাল কপি, গেজেট, ডিভিডি ও পেনড্রাইভসহ নানান নথি ছিল এসবের মধ্যে।
মোট ৮৪ জন সাক্ষীর জবানবন্দি আদালতে জমা পড়ে, যার মধ্যে ৫৪ জন সরাসরি সাক্ষ্য দেন। ১ জুলাই চার্জ শুনানি শুরু হয়ে ১০ জুলাই অভিযোগ গঠন করা হয়। এ সময় সাবেক আইজিপি মামুন দায় স্বীকার করেন।
৩ আগস্ট প্রসিকিউশনের ওপেনিং স্টেটমেন্টের মাধ্যমে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। প্রথম সাক্ষী ছিলেন গুরুতর আহত খোকন চন্দ্র বর্মন। ৮ অক্টোবর তদন্ত কর্মকর্তা আলমগীরের সাক্ষ্যের মধ্য দিয়ে সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়। ১২ অক্টোবর যুক্তিতর্ক শুরু হয়ে ২৩ অক্টোবর এটর্নি জেনারেলের সমাপনী বক্তব্যের মাধ্যমে শেষ হয়। এরপর ১৩ নভেম্বর রায় ঘোষণার দিন হিসেবে ১৭ নভেম্বর নির্ধারণ করা হয়।
প্রসিকিউশনের আনা পাঁচটি মূল অভিযোগ
অভিযোগ ১: উসকানিমূলক বক্তব্য ও সহিংসতা ছড়িয়ে দেওয়া
১৪ জুলাই গণভবনের সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনরত ছাত্রদের ‘রাজাকারের বাচ্চা’ আখ্যা দিয়ে শেখ হাসিনা উসকানিমূলক বক্তব্য দেন। এর পরই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ কর্মীদের ব্যাপক হামলা, নির্যাতন ও সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে।
সাক্ষ্যপ্রমাণ: বিটিভির ভিডিও, অন্যান্য নেতার সমর্থনমূলক বক্তব্য, যুগপৎ হামলার অনুসন্ধান প্রতিবেদন, ভিডিওফুটেজ ও প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ান।
অভিযোগ ২: উচ্চপর্যায়ের নির্দেশে হত্যাকাণ্ড ও হামলা
কাউন্ট-১: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিকে ফোন করে আন্দোলনকারীদের ‘ফাঁসি’ দেওয়ার নির্দেশ।
কাউন্ট-২: শেখ তাপসকে লেথাল উইপন ব্যবহার, ড্রোন নজরদারি ও হেলিকপ্টার থেকে গুলি চালানোর নির্দেশ।
কাউন্ট-৩: ইনুর সঙ্গে ফোনালাপে হেলিকপ্টার থেকে বোমা বর্ষণ ও আন্দোলনকারীদের জঙ্গি ট্যাগ দেওয়ার নির্দেশ।
সাক্ষ্যপ্রমাণ: এনটিএমসি থেকে সংগ্রহ করা ভয়েস রেকর্ড, ফরেনসিক রিপোর্ট, শহীদ-আহতের তালিকা, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার প্রতিবেদন, গুলি ব্যবহারের হিসাব, হেলিকপ্টারের ফ্লাইট শিডিউল, কার্ফিউ ও ‘দেখামাত্র গুলি’ নির্দেশের সরকারি আদেশ।
অভিযোগ ৩: আবু সাঈদ হত্যাকাণ্ড
১৬ জুলাই বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় আন্দোলনের সমন্বয়ক আবু সাঈদকে গুলি করে হত্যার অভিযোগ তোলা হয়।
সাক্ষ্যপ্রমাণ: এনটিভির লাইভ ভিডিও, একাধিক পোস্টমর্টেম রিপোর্ট, সাজানো মামলার নথি, প্রত্যক্ষদর্শী ও চিকিৎসকের সাক্ষ্য।
অভিযোগ ৪: চানখারপুলে ছয়জনকে গুলি করে হত্যা
৫ আগস্ট ঢাকার চানখারপুল এলাকায় পুলিশের নির্বিচার গুলিতে ছয়জন নিহত হন।
সাক্ষ্যপ্রমাণ: গুলির ভিডিওফুটেজ, শহীদ আনাসকে গুলির দৃশ্য, তার মাকে লেখা চিঠি, আহতদের হাসপাতালে নেওয়ার ভিডিও, প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্য।
অভিযোগ ৫: আশুলিয়ায় ছয়জনকে হত্যা ও লাশ পুড়িয়ে দেওয়া
৫ আগস্ট আশুলিয়ায় ছয়জনকে গুলি করে হত্যার পর তাদের লাশ আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়।
সাক্ষ্যপ্রমাণ: গুলির ভিডিও, পোড়া লাশের ছবি, পরিবারের সদস্য ও পুলিশের সাক্ষ্য।
সাক্ষীদের পরিচয়
ভুক্তভোগী, শহীদ পরিবার, আহত, সাংবাদিক, চিকিৎসক, ফরেনসিক ও ব্যালিস্টিক বিশেষজ্ঞ, আন্দোলনকারী, পুলিশ সদস্য এবং তদন্ত কর্মকর্তা—মোট ৮৪ জন সাক্ষী।
প্রসিকিউশনের দাবি
সব প্রমাণ পর্যালোচনা শেষে প্রসিকিউশন আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি ও ভুক্তভোগীদের ক্ষতিপূরণ প্রদানের আবেদন জানায়।
সূত্র – বাসস
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.