এম.এ.শাহীন,তারাগঞ্জ,রংপুরঃ
রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও দায়িত্বহীনতার চিত্র দিন দিন আরও ভয়াবহ হয়ে উঠছে। সরকারি ওষুধ চুরির কেলেঙ্কারির পর এবার প্রকাশ্যে এসেছে নতুন এক চাঞ্চল্যকর ঘটনা— হারবাল অ্যাসিস্ট্যান্ট ও মালি পদে কর্মরত গৌতম রায় দীর্ঘদিন ধরে বহির্বিভাগে বসে রোগীদের মধ্যে এলোপ্যাথি ওষুধ বিতরণ করছেন। অথচ এই দায়িত্ব পালনের জন্য নিয়োজিত ফার্মাসিস্ট প্রায়ই অনুপস্থিত বা দায়িত্বে অবহেলা করেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
স্থানীয়রা জানান, গৌতম রায়ের পদবি ‘হারবাল অ্যাসিস্ট্যান্ট (মালি)’ হলেও তিনি নিয়মিত বহির্বিভাগে বসে এলোপ্যাথি ওষুধ সরবরাহ করেন। অন্যদিকে দায়িত্বপ্রাপ্ত ফার্মাসিস্ট বেশিরভাগ সময় মোবাইলে ব্যস্ত থাকেন বা বাইরে আড্ডায় সময় কাটান। এমনকি সাংবাদিকদের প্রশ্নে ক্ষিপ্ত হয়ে হুমকি দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, এলোপ্যাথি ওষুধ বিতরণের জন্য ফার্মাসিস্ট ডিগ্রি বা প্রাসঙ্গিক প্রশিক্ষণ অপরিহার্য। অযোগ্য ব্যক্তির মাধ্যমে ওষুধ বিতরণ রোগীর জীবনকে মারাত্মক ঝুঁকির মুখে ফেলে। বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি) এবং ড্রাগ অ্যাক্ট ১৯৪০ (সংশোধিত) অনুযায়ী, অননুমোদিতভাবে ওষুধ বিতরণ একটি দণ্ডনীয় অপরাধ।
তদন্তে জানা যায়, উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. হামদুল্লাহ দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই হাসপাতালের সার্বিক পরিস্থিতি ক্রমেই অবনতির দিকে যাচ্ছে। ওষুধ চুরি, অতিরিক্ত ফি আদায়, কর্মচারীদের অপেশাদার আচরণ এখন নিয়মিত ঘটনা। স্থানীয় সূত্রে আরও জানা যায়, কিছু কর্মী মাদক সেবনের পর সাব-সেন্টারে অচেতন অবস্থায় পড়ে থাকেন, এমনকি পুলিশ হস্তক্ষেপে তাদের উদ্ধার করতে হয়।
সরকারি অ্যাম্বুলেন্স ব্যবহারে চলছে দুর্নীতি ও চাঁদাবাজি। নির্ধারিত ৫০০ টাকার পরিবর্তে ১,০০০ থেকে ১,৫০০ টাকা পর্যন্ত আদায় করা হয়, রশিদও দেওয়া হয় না। রক্ত ও অন্যান্য পরীক্ষার সময় সংশ্লিষ্ট টেকনোলজিস্টদের না পাওয়া এখন স্বাভাবিক ঘটনা। বদরগঞ্জ উপজেলা থেকে আগত এক স্বাস্থ্যকর্মী নিয়মিত দেরিতে আসেন এবং দুপুরের আগেই অফিস ত্যাগ করেন— এমন অভিযোগও প্রমাণ পাওয়া গেছে।
সবচেয়ে বেশি অভিযোগ উঠেছে চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে। অভিযোগ রয়েছে, উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. হামদুল্লাহ নিজেই ছুটি অনুমোদন ছাড়াই কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকেন। গাইনি কনসালট্যান্ট ডা. কেয়া রানীর বিরুদ্ধেও একই অভিযোগ— তিনি অফিসে স্বল্প সময় থাকেন এবং দ্রুত ব্যক্তিগত চেম্বারে চলে যান, ফলে নারী রোগীরা সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়ছেন।
এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে ডা. হামদুল্লাহ বলেন, “কেউ দায়িত্বে অবহেলা করলে অবশ্যই জবাবদিহি করতে হবে।” তবে তিনি কোনো সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করেননি।
অন্যদিকে, রংপুরের সিভিল সার্জন ডা. শাহীন সুলতানা বলেন, “এসব অনিয়মের বিষয় আমাদের নজরে এসেছে। দ্রুত তদন্ত করে দায়ীদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে, যাতে রোগীরা নিরাপদ স্বাস্থ্যসেবা পান।”
তারাগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের এই নৈরাজ্য ও অব্যবস্থাপনা নিয়ে স্থানীয়দের ক্ষোভ চরমে উঠেছে। তারা দ্রুত স্বচ্ছ তদন্ত ও দায়ীদের শাস্তির দাবি জানিয়েছেন। স্বাস্থ্যসেবা খাতে এ ধরনের অনিয়ম কেবল রোগীদের জীবনকে ঝুঁকির মুখে ফেলছে না, বরং সরকারের স্বাস্থ্যব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করছে।