সাকিব আহসান,পীরগঞ্জ, ঠাকুরগাঁওঃ
গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে ট্যাপেন্টাডল (Tapentadol) ট্যাবলেট নতুন এক যন্ত্রণা-বৃত্ত সৃষ্টি করেছে। তরুণদের দৈনন্দিন জীবনে উঠে এসেছে এই ঔষধভিত্তিক নেশা, যা শুধুই শারীরিক নয়; সামাজিক-কাঠামোগত ফাটলকে বিস্তৃত করছে। সরকার ২০২০ সালে ট্যাপেন্টাডলকে নিয়ন্ত্রণকৃত পদার্থ হিসেবে তালিকাভুক্ত করলেও পুনরাবৃত্তি করে বড় আকারের চালান ও স্থানীয় বিক্রি ধরে পড়ছে (ট্যাপেন্টাডলকে ‘নরকোটিক’ হিসেবে ব্লকলিস্ট করা হয়েছিল)।
সরকারি সার্ভে ও গবেষণা অনুযায়ী দেশভিত্তিক মাদকদ্রব্য ব্যবহারের প্রক্রিয়া দ্রুত বাড়ছে। সাম্প্রতিক DNC সার্ভে প্রায় ৮.৩ মিলিয়ন মানুষকে নেশাগ্রস্ত হিসাবে তাদের পরিসংখ্যানে অন্তর্ভুক্ত করেছে ; তাতে তরুণ ও কিশোরদের অংশ উল্লেখযোগ্য। এই পরিসংখ্যানের প্রেক্ষাপট বাংলাদেশে নতুন প্রজন্মের ওপর মাদক প্রবেশকে জাতীয় সংকটে পরিণত করছে।
ট্যাপেন্টাডল কেন বিপজ্জনক? ক্লিনিক্যাল ওষুধবিজ্ঞানে এটি একটি অপিওয়েড-ধাঁচের শক্তিশালী ব্যথানাশক; অতিমাত্রায় সেবন করলে ফিজিওলজিক্যাল নির্ভরশীলতা গঠে অনিদ্রা, পেশী ব্যথা, ঘাম, উর্দ্ধশ্বাসহীনতা, বমি-এমনকিছু প্রত্যাহার উপসর্গ দেখা চলে; দীর্ঘকালীন সেবনে মনোস্থৈর্য ও সিদ্ধান্তগ্রহণে ক্ষয় দেখা যায়। মার্কিন এক ওষুধবিষয়ক মনোগ্রাফ এবং সাম্প্রতিক গবেষণা ট্যাপেন্টাডলের অপব্যবহার ও নির্ভরশীলতার ঝুঁকি রেকর্ড করেছে।
এটি কি ‘সামাজিক-অপসারণ’ (social failure) নয়, নাকি উদ্দেশ্যমূলকভাবে রাজনীতি ও অর্থনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য প্রয়োগ করা কোনো ষড়যন্ত্র? ইতিহাস দেখায়—আন্তর্জাতিকভাবে মাদক-রাজনীতি (narco-politics) এবং কখনো কখনো রাষ্ট্রীয় বা গোয়েন্দা হস্তক্ষেপ নিয়ে বিতর্ক বহু দেশেই হয়েছে। গ্যারি ওয়েবের “Dark Alliance” ইশতেহারে কনট্রা বিদ্রোহীদের সঙ্গে কোকেইন-চক্রের সম্পর্ক এবং সিআইএ নিয়ে বিতর্কের উদাহরণ উঠে আসে; যদিও পরে আলোচনায় জটিলতা ও সমালোচনা মেশে, তথাপিও স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক স্বার্থ-নেভিগেশনের মধ্যে মাদক পরিচালনার ইতিহাস আছে। তাত্ত্বিক বিশ্লেষকরা দেখান—নেশা ব্যবস্থার বিস্তারের পেছনে রাষ্ট্র ও অপরাধী নেটওয়ার্কের জটিল সম্পর্ক থাকতে পারে যা রাজনৈতিক সুবিধা বা সামাজিক অবস্থা শক্তিশালী করে।
তবে সরাসরি প্রমাণ ছাড়া ‘কোনো দেশের সরকার ও আন্তর্জাতিক খেলোয়াড়রা পরিকল্পিতভাবে টার্গেট করে তরুণদের ওপর Narco Politics প্রয়োগ করেছে’ এমন সর্বজনীন অভিযোগ বলার আগে ব্যাপক তথ্য ও কেস স্টাডি দরকার। ল্যাটিন আমেরিকার বহু ক্ষেত্রে (কলম্বিয়া, মেক্সিকো) রাষ্ট্র-অবৈধ নেটওয়ার্কের জড়িত থাকার সুপাঠ্য দলিল ও তদন্ত আছে; তবে প্রত্যেক দেশের প্রসঙ্গে আলাদা প্রমাণ সংগ্রহ জরুরি।
সীমান্তবর্তী উপজেলা পীরগঞ্জের সাম্প্রতিক প্রেক্ষাপট (ঠাকুরগাঁও) বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে যে পীরগঞ্জ উপজেলা প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পীরগঞ্জে ট্যাপেন্টাডল ও ইয়াবা সম্পর্কিত গ্রেপ্তার ও মাদকদ্রব্য বাজেয়াপ্ত ব্যাপকভাবে বাড়িয়েছে। একাধিক অভিযানে কয়েকশো পিচ ট্যাবলেট উদ্ধার ও ব্যবসায়ীদের আটক হওয়ার খবর পাওয়া যায়, যা স্থানীয় চেইনে এই নেশার উপস্থিতি নির্দেশ করে। এসব খবর দেখলে মনে হয় সীমান্ত-নিকটবর্তী ও আর্থ-সামাজিক অবকাঠামোগত দুর্বলতার জেলায় সহজভাবে নতুন ড্রাগ প্রবেশ করছে।
ছদ্মনামে একটি মাদক বিক্রেতার স্বীকারোক্তি (সংকলিত),“আমরা বড় চালান নেই, ছোট ছোট প্যাকেটে এনে বাজারে ছড়াই, গ্রাহকরা বেশি চায়, প্রাইসটা বাড়লেও কেনা হয়। যারা শুরু করে তারা দ্রুত ‘নিশ্চিত ক্রেতা’ হয়ে যায়।এটা ব্যবসা, রাজনীতি নয়।”
নেশাগ্রস্তের (ছদ্মনাম ‘রাফি’) বর্ণনামতে, “শুরুতে ক্লাশে ফোকাস করার মতো থাকতেও আমি ট্যাবলেট খেতাম, পরে না খেলে শরীর কাঁপে, ঘুম আসে না, মন অস্থির থাকে। কাজে মন যায় না, রাগ দ্রুত চাপে ওঠে, নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারাই।” ডাক্তারদের ভাষ্যমতে, এটি ক্লিনিক্যালভাবে অপিওয়েড-প্রত্যাহার ও মানসিক দিক থেকে আসক্তির পরিচয়।
স্থানীয়ভাবে পীরগঞ্জে সচেতনতা বৃদ্ধি , প্রেসক্রিপশন-মানিটরিং ও ছায়াক্লিনিক স্থাপন দ্রুত প্রয়োগযোগ্য পদক্ষেপ হতে পারে। একই সঙ্গে স্বাধীন তদন্ত করে যদি আন্তর্জাতিক বা রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কোনো নির্ভরযোগ্য সূত্র পাওয়া যায়, সেটা পেশ করা উচিত,প্রমাণভিত্তিক পর্যালোচনাই নীতি প্রয়োগকে শক্ত করবে।