ঠাকুরগাঁও,রংপুর, প্রতিনিধিঃ
আনন্দ মার্গ (আনন্দের পথ) বা আনন্দ মার্গ প্রচারক সংঘ একটি বিশ্বব্যাপী সামাজিক ও আধ্যাত্মিক সংগঠন। ১৯৫৫ সালে ভারতের বিহারের জামালপুরে প্রভাত রঞ্জন সরকার (শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তি) এর নেতৃত্বে এর প্রতিষ্ঠা হয়। তিনি বিশ্বের অন্তত ১৩০টি দেশের মানুষের মধ্যে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন, আর ভক্তরা তাঁকে ‘আনন্দের মূর্তি’ বা আদর করে ‘বাবা’ (পিতা) বলে ডাকে। বর্তমানে আনন্দ মার্গ ১৮০টিরও অধিক দেশে সক্রিয়। এর নামের বাংলা অর্থ ‘আনন্দের পথ’, যা সীমাহীন সুখ–আনন্দের সাধনায় দীক্ষিত হওয়ার লক্ষ্যের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়। সংগঠনের মূলমন্ত্র “আত্মমোক্ষার্থং জগদ্ধিতায় চ”, অর্থাৎ আত্মার মুক্তি ও সার্বজনীন কল্যাণ সাধন।
আগামী ৮- ১০ অক্টোবর আনন্দ মার্গ প্রচারক সংঘ, বাংলাদেশ-র সভাপতি ও রিজিওনাল সেক্রেটারী আচার্য সুজিতানন্দ অবধূত এঁর আহ্বানে পীরগঞ্জ উপজেলার বোলদিয়ারায় আনন্দ উত্তরা মাস্টার ইউনিটে অনুষ্ঠিতব্য ‘বাবা নাম কেবলম্’ কীর্ত্তন দিবসে থাকছে সাধনা ও ভক্তিরস কীর্ত্তন মহিমার উপর আলোচনা, ২৪ ঘন্টাব্যাপী অখন্ড কীর্ত্তন, ধর্মীয় আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং বিনামূল্যে সবজি বীজ বিতরণ, দাতব্য চিকিৎসা সেবা প্রদান ও নরারয়ণ সেবা। এই কীত্তন দিবসে বিভিন্ন জেলা হতে হরিপরি মন্ডল গোষ্ঠীর কীর্ত্তনিয়া দল যোগদান করবেন।
আনন্দ মার্গের আদর্শমতে ব্যক্তির আত্মসাক্ষাৎ এবং বিশ্বের কল্যাণ পরস্পরের পরিপূরক। প্রতিষ্ঠাতা শ্রী আনন্দমূর্ত্তি নির্দেশ দিয়েছেন যে ব্যক্তি ও সমাজের উন্নয়নের মধ্যে সেতুবন্ধন গড়ে তুলতে হবে। সংগঠনটি শুধুমাত্র যোগ-ধ্যানে সীমাবদ্ধ নয়; বরং একটি বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক জীবনদর্শন হিসেবে কাজ করে, যা মানুষের শারীরিক, মানসিক ও আত্মিক চাহিদা পূরণে সাহায্য করে। এই দর্শন অনুযায়ী ‘স্ব-উদ্ধার এবং মানবসেবা’ সংমিশ্রণই মূলমন্ত্র। এর ফলে আনন্দ মার্গে ব্যক্তির সর্বাঙ্গীন উন্নয়ন এবং সামাজিক কল্যাণ, দুটি লক্ষ্যই সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়।
আনন্দ মার্গের মতবাদে আত্মসাক্ষাৎ এবং সমাজসেবার মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব নেই; বরং একে অপর পরিপূরক। শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তি তাঁর কর্মজীবন শুরু থেকেই সমান্তরালভাবে ধর্মচর্চা ও মানবসেবায় জোর দিয়েছেন। তিনি প্রশিক্ষিত সন্ন্যাসীদের পাঠিয়ে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ এবং পরবর্তীতে সমগ্র বিশ্বে “Self-realization and service to humanity” অর্থাৎ আত্মউন্নয়ন ও মানবসেবার শিক্ষা ছড়িয়ে দেন। তাই আনন্দ মার্গে যোগ-ধ্যানের মাধ্যমে ব্যক্তির মানসিক ও আধ্যাত্মিক উন্নয়ন এবং স্কুল, এতিমখানা, বিনামূল্যে খাদ্য বিতরণ ইত্যাদি সামাজিক কর্মসূচির মাধ্যমে সমাজসেবাকে সমান্তরাল গুরুত্ব দেওয়া হয়।
আনন্দ মার্গের কার্যক্রম আন্তর্জাতিকভাবে বিস্তৃত। প্রায় প্রতিটি দেশে এ সংগঠনের নিজস্ব কেন্দ্র রয়েছে। এসব কেন্দ্র থেকে নিয়মিত ধ্যান ও যোগ প্রশিক্ষণের পাশাপাশি স্কুল, শিশু-আশ্রয়কেন্দ্র, বিনামূল্যে খাদ্য বিতরণ কেন্দ্র, মেডিকেল ক্যাম্প এবং অন্যান্য সাম্প্রদায়িক উন্নয়ন প্রকল্প পরিচালিত হয়। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৬৩ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘শিক্ষা, ত্রাণ ও কল্যাণ সেকশন’ (ERAWS) বিশ্বজুড়ে স্কুল, এতিমখানা, ঔষধালয় ও বিনামূল্যে রান্নাঘর পরিচালনা করে। এছাড়া ‘আনন্দ মার্গ ইউনিভার্সাল রিলিফ টিম’ (AMURT) নামের একটি বিশেষ ইউনিট প্রাকৃতিক বিপর্যয়কালে ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রম করে চলেছে, যা জাতিসংঘ, রেড ক্রসসহ অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রশংসা পেয়েছে।
আনন্দ মার্গের সমাজদর্শনটি সার্বজনীনবাদে বিশ্বাস করে। এতে ঈশ্বরকে সীমাহীন সর্বশক্তিমান হিসেবে ধরা হয় এবং সমস্ত প্রাণীকে একটি মহাজাগতিক পরিবারের অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। শ্রী আনন্দমূর্ত্তি উদ্ভাবিত নিও-হিউম্যানিজম তত্ত্ব মানবতাবাদের ধারণাকে আরও বিস্তৃত করে, প্রাণী, উদ্ভিদ ও প্রকৃতির প্রতি স্নেহ ও সহানুভূতির প্রয়োজনীয়তা বলেন। আনন্দ মার্গ বর্ণ, ধর্ম, জাতপাত বা সামাজিক অবস্থার ভিত্তিতে কোনো বৈষম্য মানে না; বরং প্রত্যেকেরই কল্যাণ এবং সমান উন্নয়নের সুযোগ নিশ্চিত করার উপর জোর দেয়। এই দৃষ্টিভঙ্গি শান্তি ও ন্যায়ের বিশ্ব গড়ায় বিশ্বাস করে, যাতে সমগ্র মানবতার কল্যাণ অটুট থাকে।