সাকিব আহসান,পীরগঞ্জ, ঠাকুরগাঁওঃ
বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্তবর্তী অঞ্চল পীরগঞ্জে এক নতুন ধরনের আর্থিক অপরাধ দ্রুত বিস্তার লাভ করছে—ক্রিপ্টো পঞ্জি, ডিজিটাল জুয়া ও ফরেক্স প্রতারণা। দুই দেশের তরুণ সমাজকে ‘এআই ট্রেডিং’, ‘বট ইনকাম’, ‘অটোমেটেড প্রফিট’ প্রভৃতি প্রলোভন দিয়ে টেনে নেওয়া হচ্ছে এমন এক জগতে, যেখানে বিনিয়োগ নয়, মূল লক্ষ্য নতুন সদস্যের টাকা সংগ্রহ।
সম্প্রতি ভারতের মুজাফফরনগরে ২১০ কোটি টাকার ফরেক্স প্রতারণা মামলায় ইডি (Enforcement Directorate) বিপুল অভিযান চালিয়ে ৯৪ লাখ রুপি নগদ, ব্যাংক রেকর্ড, ও ডিজিটাল ডিভাইস জব্দ করেছে। এই চক্রের মূল হোতা ল্যাভিশ চৌধুরী, যিনি ‘নবাব আলী’ ছদ্মনামে QFX Trade Ltd, YFX, BotBro, TLC Coin, ও Yorker FX নামে একাধিক কোম্পানি খুলে মাসিক ৫–৬% লাভের প্রতিশ্রুতি দিয়ে হাজারো বিনিয়োগকারীকে ঠকিয়েছেন। ইডির তদন্তে প্রমাণ মিলেছে—এই অর্থের বড় অংশ ডিজিটাল কারেন্সি ও অফশোর অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে পাচার করা হয়েছে।
একই রকম চিত্র দেখা যাচ্ছে ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জে। বিদেশভিত্তিক এক্সচেঞ্জ প্ল্যাটফর্ম, বিশেষত Binance, ব্যবহার করে স্থানীয় পর্যায়ে “ক্রিপ্টো ট্রেডিং” বা “AI-বট ইনভেস্টমেন্ট” নামে নতুন এক পিরামিড স্কিম চালানো হচ্ছে। ব্যবহারকারীরা P2P (peer-to-peer) মাধ্যমে bKash, নগদ, বা রকেট দিয়ে টাকা পাঠাচ্ছেন, যার পরিমাণ লাখ ছাড়িয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক বারবার সতর্ক করেছে যে ভার্চুয়াল মুদ্রা, ক্রিপ্টোকারেন্সি বা ফরেক্স ট্রেডিং কোনোভাবেই দেশের আইনে অনুমোদিত নয়। বাংলাদেশ ব্যাংক আদেশ (২০১৭) অনুসারে, “ভার্চুয়াল মুদ্রা ব্যবহারের মাধ্যমে লেনদেন বা মুদ্রা ক্রয়-বিক্রয় অপরাধ” হিসেবে গণ্য হতে পারে। পাশাপাশি, মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ (PMLA)-এর ধারা ২(ভ) অনুযায়ী, যে কোনো ডিজিটাল লেনদেনের মাধ্যমে অবৈধ অর্থ স্থানান্তর মানি লন্ডারিং অপরাধ হিসেবে বিবেচিত।
এছাড়া, আইসিটি আইন ২০০৬ (সংশোধিত ২০১৩)-এর ৫৬ ও ৬৩ ধারায় অননুমোদিত অনলাইন আর্থিক লেনদেন বা ডিজিটাল প্রতারণার জন্য জরিমানা ও সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। একইভাবে, দণ্ডবিধি ৪২০ ধারা অনুসারে “প্রতারণা ও অসৎ উদ্দেশ্যে অর্থ আত্মসাৎ”-এর অপরাধে শাস্তি হতে পারে সর্বোচ্চ সাত বছরের কারাদণ্ড ও জরিমানা।
Bangladesh Financial Intelligence Unit (BFIU) ইতোমধ্যে কয়েকটি ব্যাংক ও মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস (MFS) অ্যাকাউন্টে Binance ও অন্যান্য এক্সচেঞ্জ সংযুক্ত সন্দেহজনক লেনদেন শনাক্ত করেছে। এসব অ্যাকাউন্ট থেকে পাওয়া গেছে ভার্চুয়াল অ্যাসেট ক্রয়-বিক্রয়, যা প্রকৃত বিনিয়োগ নয় বরং একধরনের অর্থ পাচার ও ডিজিটাল জুয়া।
এই প্রতারণাগুলোর গঠনগত ধরন হল এক নতুন বিনিয়োগকারীর টাকা দিয়ে পুরোনো বিনিয়োগকারীর লাভ দেওয়া হয়, অর্থাৎ Ponzi স্কিম। যখন নতুন সদস্য যোগ দেওয়া বন্ধ হয়, তখন প্ল্যাটফর্ম অদৃশ্য হয়, সার্ভার বন্ধ হয়ে যায়, আর ব্যবহারকারীরা তাদের সঞ্চয় হারায়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জনৈক অর্থনীতি বিশেষজ্ঞ বলেছেন, “এই ধরনের স্কিম কেবল অর্থনৈতিক প্রতারণা নয়, বরং সামাজিক ও জাতীয় নিরাপত্তার ঝুঁকি।” পীরগঞ্জ উপজেলা প্রশাসন ও আইনশৃংখলাবাহিনী এই চক্রের সন্ধানে দিনরাত পরিশ্রম করে যাচ্ছে।