সাকিব আহসান,পীরগঞ্জ, ঠাকুরগাঁওঃ
ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জ একটি বহুমাত্রিক সম্ভাবনার জনপদ। সমসাময়িক সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনগুলো বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, এই অঞ্চলের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে দ্রুত পরিবর্তন ঘটছে। এই পরিবর্তন আগামী দিনের পীরগঞ্জকে নতুন আঙ্গিকে গড়ে তুলতে পারে, আবার বিভিন্ন সমস্যার জালে আটকে রাখতেও পারে। তাই একটি সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োজন।
পীরগঞ্জের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি কৃষি। ধান, আলু, ভুট্টা ও বিভিন্ন ফলন এ অঞ্চলের কৃষকদের জীবনধারণের প্রধান অবলম্বন। তবে আধুনিক কৃষি প্রযুক্তির ব্যবহার, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত চ্যালেঞ্জ ও বাজার ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা কৃষিকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে। আগামী দিনে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প, বিশেষত কৃষি-প্রসেসিং শিল্প গড়ে উঠতে পারে। সেতাবগঞ্জ সুগার মিল ও আঞ্চলিক ক্ষুদ্র কারখানার পুনর্জাগরণ পীরগঞ্জের অর্থনীতিকে নতুন ভিত্তি দিতে পারে।
প্রতিনিয়ত রাজনৈতিক অস্থিরতা ও দলীয় বিভাজন পীরগঞ্জের সামাজিক কাঠামোকে প্রভাবিত করছে। একদিকে সাধারণ মানুষ চিকিৎসা, শিক্ষা ও মৌলিক সেবার অভাবে ভোগে, অন্যদিকে দলীয় আনুগত্যের ভিত্তিতে ক্ষমতার লড়াই বাড়ছে। এতে সামাজিক আস্থার সংকট তৈরি হতে পারে। তবে তরুণ প্রজন্মের শিক্ষিত অংশ ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার দাবি তুলতে শুরু করেছে—যা ভবিষ্যতে ইতিবাচক পরিবর্তনের ইঙ্গিত বহন করে।
প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার পরিসর বৃদ্ধি পেলেও মানসম্মত শিক্ষা এখনো বড় চ্যালেঞ্জ। দুর্নীতি, শিক্ষক সংকট ও বই-কেলেঙ্কারির মতো ঘটনায় জনগণের আস্থা নষ্ট হচ্ছে। চিকিৎসাক্ষেত্রেও একই অবস্থা—চিকিৎসক বদলি, অনিয়ম এবং প্রভাবশালীদের হস্তক্ষেপ জনস্বাস্থ্যের ঝুঁকি বাড়ায়। যদি জবাবদিহিমূলক স্বাস্থ্য ও শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা যায়, তবে মানবসম্পদ উন্নয়ন ঘটবে এবং এটি অর্থনীতিকে গতিশীল করবে।
পীরগঞ্জে অসংখ্য নদী, খাল ও জলাশয় রয়েছে, যা কৃষি ও জীববৈচিত্র্যের জন্য অপরিহার্য। কিন্তু বেপরোয়া মাছ শিকার, দখল ও দূষণের কারণে এ সম্পদ ঝুঁকিতে। ভবিষ্যতে পরিবেশবান্ধব নীতি গ্রহণ ও স্থানীয় জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি হলে জলাশয় পীরগঞ্জের অর্থনীতির অন্যতম ভরকেন্দ্রে পরিণত হতে পারে।
পীরগঞ্জের সংস্কৃতিতে বৈচিত্র্য রয়েছে। হিন্দু, মুসলিম, সাঁওতালসহ বহু সম্প্রদায়ের সহাবস্থান একে সমৃদ্ধ করেছে। দুর্গাপূজা, ঈদ, নববর্ষ কিংবা সাঁওতালদের নৃত্যগান স্থানীয় সংস্কৃতিকে প্রাণবন্ত করে। ধর্মীয় অনুশাসন এখানকার সামাজিক নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখলেও কট্টরপন্থা যদি প্রভাব বিস্তার করে, তবে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি হুমকির মুখে পড়তে পারে।
দুর্নীতি পীরগঞ্জের উন্নয়নকে দীর্ঘদিন ধরে পিছিয়ে দিচ্ছে। সরকারি সেবা বণ্টনে দলীয়করণ, নিয়োগে অনিয়ম ও প্রকল্প দুর্নীতি সামাজিক আস্থা ভেঙে দিয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তরুণ সমাজের মধ্যে মাদকাসক্তির প্রসার, যা উৎপাদনশীল জনশক্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এ সমস্যা নিয়ন্ত্রণে না আনতে পারলে পীরগঞ্জের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।
পীরগঞ্জ এক দ্বিমুখী সম্ভাবনার সড়কে দাঁড়িয়ে আছে। একদিকে কৃষি, শিল্প, সংস্কৃতি ও মানবসম্পদ উন্নয়নের মাধ্যমে একটি উন্নত অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাঠামো গড়ে ওঠার সুযোগ রয়েছে; অন্যদিকে দুর্নীতি, মাদক, রাজনৈতিক বিভাজন ও পরিবেশ সংকট এ অঞ্চলের অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। স্বচ্ছ নেতৃত্ব, শিক্ষিত তরুণ প্রজন্মের উদ্যোগ ও স্থানীয় জনগণের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা পীরগঞ্জকে আগামী দিনে সমৃদ্ধ ও টেকসই জনপদে রূপান্তরিত করতে পারে।