সাকিব আহসান,পীরগঞ্জ, ঠাকুরগাঁওঃ
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ভারতের বিভাজনের পর পীরগঞ্জ ঠাকুরগাঁও জেলার অন্তর্গত পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশ) অন্তর্ভুক্ত হয়। এখানে মূলত কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি থাকলেও রাজনৈতিকভাবে এর মানুষ ছিল সচেতন ও সক্রিয়। ১৯৪০–৫০-এর দশকে হাজী মুহাম্মদ দানেশের নেতৃত্বে তেভাগা আন্দোলন চলে, যা জমিদার প্রথা উচ্ছেদে ভূমিহীন কৃষকদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখে। পরবর্তী সময়ে ১৯৬০–৭০ দশকে পীরগঞ্জের কিছু তরুণ বাম ও নক্সাল ভাবধারার সাথে যুক্ত হন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় স্থানীয় প্রবীণ নেতা ডাঃ আব্দুর রাজ্জাক প্রতীকীভাবে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন এবং আনসার সদস্য ইসাহাক আলী শহীদ হন। এই ঘটনাবলি পীরগঞ্জবাসীর মধ্যে এক নতুন রাজনৈতিক চেতনা তৈরি করে।
পীরগঞ্জের অর্থনীতি প্রধানত কৃষি নির্ভর; ধান, গম, শাকসবজি চাষের পাশাপাশি এখানে চাল ও তেল উৎপাদনের মিল ছিল। যোগাযোগ ব্যবস্থার আধুনিকায়নে পুরনো খাঁচক ও বলদগাড়ি প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। পীরগঞ্জ সবসময়ই ধর্ম-বৈচিত্র্যময়; এখানে মুসলিম ও হিন্দু উভয় সম্প্রদায়ের বিদগ্ধ নেতারা ছিল এবং সহাবস্থান গড়ে ওঠে। এছাড়া স্থানীয় শিক্ষিত মুসলিম ও হিন্দু সমাজনেতারাও উন্নয়নে অবদান রেখেছেন। ২০১১ সালের তথ্য অনুযায়ী অঞ্চলটিতে ৩৭টি মসজিদ ও ৪০টি মন্দির ছিল। প্রবীণদের মতে, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা পরবর্তী সামাজিক আন্দোলন মানুষের মধ্যে আত্মবিশ্বাস ও ঐক্যের বোধ জাগিয়ে তোলে, যার প্রভাব স্বাধীনতা পরবর্তী উন্নয়নে লক্ষণীয়।
উল্লেখযোগ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে পীরগঞ্জ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় (১৯০৭), পীরগঞ্জ ডিগ্রি কলেজ (১৯৬৪) অন্যতম। এছাড়া জাবরহাট উচ্চ বিদ্যালয় (১৯৬০) ও পীরগঞ্জ বণিক সরকারি বালিকা বিদ্যালয় (১৯৭০) প্রতিষ্ঠিত হয়। সাংস্কৃতিক সংগঠন হিসেবে ‘সমকাল সংস্কৃতিক গোষ্ঠী’, ‘গীতবীথি সংগীত নিকেতন’ ও উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী উল্লেখযোগ্য। এর ফলে স্থানীয় শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী প্রজন্ম গড়ে ওঠে।
পীরগঞ্জসহ ঠাকুরগাঁও অঞ্চল বরাবরই কৃষক সংগঠনের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। ১৯৪৬–৪৭ সালের তেভাগা আন্দোলনে ঠাকুরগাঁও-এর প্রধান নেতা ছিলেন হাজী মোহাম্মদ দানেশ। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়েও স্থানীয় রাজনীতিতে কৃষকনেতা দানেশসহ বামপন্থী মতাদর্শের প্রভাব ছিল উল্লেখযোগ্য। মুক্তিযুদ্ধ-পূর্ব পার্টিশনের অশান্ত পরিবেশে আদিবাসী ও কৃষক সম্প্রদায়ের মাঝে স্বাধিকারমুখী চেতনা বৃদ্ধি পায়। অঞ্চলের শিক্ষিত মুসলিম ও হিন্দু নেতারাও সামাজিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখেন; উদাহরণস্বরূপ, সংস্কৃতি ও রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন গোলাম মোস্তফা, সতীশচন্দ্র দত্ত, জগদীশচন্দ্র দাস প্রমুখ।
পীরগঞ্জের শিক্ষাব্যবস্থা প্রচুর প্রতিষ্ঠান সমৃদ্ধ। পৌর শহরের প্রাচীন পীরগঞ্জ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় (প্রতিষ্ঠিত ১৯০৭) এবং পীরগঞ্জ সরকারি কলেজ (উত্তীর্ণ হয়ে ১৯৬৪ সালে ডিগ্রি কলেজ) শিক্ষার আলোকবর্তিকা। এগুলির পাশাপাশি হাজারো সরকারি ও বেসরকারি স্কুল ও কলেজ এলাকার শিক্ষার প্রসারে ভূমিকা রেখেছে। সামাজিক-সাংস্কৃতিক চর্চায় এমন প্রতিষ্ঠানগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। স্থানীয় সংস্কৃতি-সাহিত্য ও নাট্যাঙ্গনে মুসলিম ও হিন্দু দুই সম্প্রদায়ের শিল্পী ও নেতা সক্রিয় ছিলেন; যেমন মুক্তিযোদ্ধা ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ডাঃ গোলাম মোস্তফা, নাট্যকার সতীশচন্দ্র দত্ত, জগদীশচন্দ্র দাস, নাগরিক নেতা ইমদাদুল হক, হাফিজ উদ্দিন আহম্মেদ ও নাজমা বেগম প্রমুখ। আধুনিক সময়ে উদীচী শিল্পী সংঘ, সঙ্গীত শিল্পী পরিষদ, থিয়েটার দল প্রভৃতি সাংস্কৃতিক গ্রুপ গড়ে উঠেছে। কালানুক্রমে নাট্যচর্চা অব্যাহত না থাকলেও স্থানীয় পত্রিকা ও সাহিত্যচর্চার মাধ্যমে নতুন প্রজন্মের আবির্ভাব ঘটেছে।
পীরগঞ্জের প্রধান আয়রোজগার কৃষিকাজ। সর্বসাধারণের অধিকাংশ (প্রায় ৮১%) লোক কৃষি ও কৃষিশ্রমী হিসাবে কর্মরত ছিল। এখানকার মাটি উর্বর; ইরি–আমন ধান, আলু, শাকসব্জি, সরিষা প্রভৃতি ফসল প্রচুর উৎপাদিত হতো। শিল্পকারখানা অত্যন্ত সীমিত: উপজেলা জুড়ে কেবল একটি আধুনিক ‘অলিম্পিয়া’ নামের অটো রাইস মিল ছিল এবং কয়েকশ চালঘর・আটাকল চালু ছিল, যেখানে প্রায় ৫ হাজার শ্রমিক কর্মরত ছিল। ১৯৭১–১৯৯৬ সালের মধ্যে বৃহৎ কারখানা না থাকায় স্থানীয় অর্থনীতি সাধারণত ছোট ও কুটির শিল্পের ওপর নির্ভরশীল ছিল। জীবনযাত্রার পরিবর্তনের ধারায় ঐতিহ্যবাহী পালকি, গরীবাড়ী প্রভৃতি যানগুলি বিলুপ্তির পথে; এখন বেশি পারিপার্শ্বিক রাস্তা ও সড়ক যোগাযোগ ব্যবহৃত হচ্ছে।
১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামে পীরগঞ্জ ছিল গুরুত্বপূর্ণ মোড়। ঢাকার ৭ই মার্চের আহ্বানের পর ২৩শে মার্চ পীরগঞ্জেও পাকিস্তানি পতাকা পোড়িয়ে স্বাধীনতা পতাকা উত্তোলন করা হয় এবং ‘আমার সোনার বাংলা’ গান পরিবেশন করা হয়। ২৫শে মার্চ কালরাত্রির পর পাক হানাদার বাহিনী প্রবেশ করে; পীরগঞ্জের আনসার ইসাহাক আলী ছিলেন প্রথম শহীদ। ১৭ই এপ্রিল পাক বাহিনী আস্তানায় থাকে এবং কয়েকজন স্থানীয় শোলাকম নেতা–ব্যক্তিত্বকে হত্যা করে। দীর্ঘ সংগ্রামের পর অবশেষে ৩ ডিসেম্বর ১৯৭১-এ পীরগঞ্জ মুক্ত হয়। প্রবীণদের স্মৃতিতে, মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের পরে স্থানীয় মানুষ হাজারো উল্লাসে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে স্বাধীনতা উদযাপন করেছিলেন। এই অভিজ্ঞতার পর দীর্ঘকাল ধরে এলাকার মানুষ স্বাধীনতা ও উন্নয়নের আশা নিয়ে উদ্দীপ্ত ছিলেন।
পীরগঞ্জ উপজেলার জনসংখ্যায় মুসলিম (প্রায় ৬৯%) সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও উল্লেখযোগ্য হিন্দু সংখ্যান (প্রায় ৩০%) রয়েছে। অতীতেও ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ঐতিহ্য ছিল; দু’ধর্মের মানুষ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ করত। স্থানীয় কুসংস্কার-বর্জিত পরিবেশে হিন্দু-মুসলিম একসঙ্গে মিলে মিশে সংসার করত এবং বিভিন্ন উৎসবে মিলেমিশে উদযাপন করত। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সংগঠন যেমন উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী, গীতবীথি, দেয়াল পত্রিকা প্রভৃতি হিন্দু-মুসলিম উভয়ের নেতৃত্বে পরিচালিত হয়েছে। কালান্তরে সামাজিক মানসিকতায় ভেদাভেদ অনেকাংশে কমে গিয়েছে, এবং প্রবীণরা তাই পীরগঞ্জে দীর্ঘ স্থায়ী সহাবস্থানের কথাই স্মরণ করেন।
তথ্যসূত্র: বাংলাদেশ সময় (Banglapedia, আধুনিক সংবাদপত্র) এবং স্থানীয় ঐতিহাসিক প্রতিবেদন।
পীরগঞ্জ উপজেলা (বাংলাপিডিয়া); Haji Mohammad Danesh – Banglapedia; পীরগঞ্জের ইতিহাস (ইত্তেফাক); পীরগঞ্জ উপজেলা (উইকিপিডিয়া)।