
নারায়ণগঞ্জের তল্লায় মসজিদে বিস্ফোরণকাণ্ডে অবহেলার অভিযোগে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের ৮ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে গতকাল সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। এছাড়া ২০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে মামলা হয়েছে ১০ জনের বিরুদ্ধে। ভয়াবহ এই অগ্নিকাণ্ডে এ পর্যন্ত দগ্ধ ৩৭ জনের মধ্যে ২৭ জন মারা গেছেন। অবশিষ্ট ১০ জনের মধ্যে ৯ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।
জানা গেছে, এ অপকর্মের মাধ্যমে সংশ্লিষ্টরা প্রায় ২০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। অভিযোগের পাহাড় কাঁধে নিয়েও ঢিমেতালে চলতে থাকা তিতাসকে আগে থেকেই কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়ে আসছিল বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়।
এ ছাড়া গত ফেব্রুয়ারিতে রাজধানীর কুড়িল বাড্ডা এলাকায় মাত্র এক রাতে ১২৪৭টি আবাসিক চুলা নিয়ম-বহির্ভূতভাবে তিতাসের মূল সার্ভারে যুক্ত করার অভিযোগে গতকাল বাড্ডা থানায় তিতাসের ৫ কর্মকর্তা, ৪ কর্মচারী ও এক ঠিকাদারের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। এতে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে আরও ৮-১০ জনকে।
তল্লার মসজিদে বিস্ফোরণকাণ্ডের জেরে দায়িত্বে অবহেলার দায়ে যাদের সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে তারা হলেন- ব্যবস্থাপক প্রকৌশলী মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম, উপব্যবস্থাপনা প্রকৌশলী মাহমুদুর রহমান রাব্বী, সহকারী প্রকৌশলী এস.এম. হাসান শাহরিয়ার, সহকারী প্রকৌশলী মানিক মিয়া, সিনিয়র সুপারভাইজার মো. মনিবুর রহমান চৌধুরী, সিনিয়র উন্নয়নকারী মো. আইউব আলী, সাহায্যকারী মো. হানিফ মিয়া এবং প্রকর্মী মো. ইসমাইল প্রধান।
এ দিকে গতকাল ভার্চুয়াল এক বৈঠকে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলোর উদ্দেশে বলেন, আগামী দুই মাসের মধ্যে অবৈধ সব গ্যাসলাইন অপসারণ করতে হবে। পরিকল্পিত এলাকার বাইরে বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগ দেওয়া যাবে না। অক্যুপ্যান্সি সার্টিফিকেট অনুসারে সংযোগ না নিলে দ্রুত সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হবে।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, কর্মকর্তাদের দুর্নীতি ও অসদাচারণের জন্য রাজনীতিবিদদের তথা সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হচ্ছে। কোন বিভাগের কোন কোন কর্মকর্তা অবৈধ কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত, তাদের তালিকা করা হচ্ছে। কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ এলে প্রথমে তাকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করে পরে অভিযোগ তদন্তের ব্যবস্থা নিতে বলেন প্রতিমন্ত্রী।
এ ছাড়া ট্রান্সমিশন লাইনের ওপর কোনো ভবন বা স্থাপনা থাকলে দ্রুত অপসারণ করতে হবে। গ্যাসের বকেয়া বিল সংগ্রহের টাইমলাইনও নির্ধারণ করতে এবং বিলখেলাপিদের তালিকা হালনাগাদ করে মন্ত্রণালয়ে প্রেরণে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেন তিনি।
বৈঠকে অন্যদের মধ্যে জ্বালানি বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. আনিছুর রহমান, পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান এবিএম আবদুল ফাত্তাহ্ ও বিতরণ কোম্পানিগুলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালকবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
অন্যদিকে মসজিদে বিস্ফোরণে তিতাসের ৮ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে সাসপেন্ড করা এবং কুড়িল বাড্ডার ঘটনায় তিতাসের ব্যবস্থাপক মাহবুব উল আলম বাদী হয়ে ১০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী আলী মো. আল মামুন।
তিনি বলেন, নারায়ণগঞ্জের তল্লায় মসজিদে বিস্ফোরণের ঘটনায় প্রাথমিকভাবে আমরা ৮ কর্মকর্তা কর্মচারীকে সাময়িক বহিষ্কার করেছি। তদন্ত প্রতিবেদন শেষে দায়ীদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
তিনি বলেন, তিতাসে আমরা শুদ্ধি অভিযান শুরু করেছি। কারও বিরুদ্ধে অনিয়মের সঙ্গে জড়িত থাকার প্রমাণ পেলে তার বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ দিকে এক ঠিকাদারসহ যে ১০ জনের বিরুদ্ধে বাড্ডা থানায় মামলা হয়েছে তাদের মধ্যে রয়েছে- ১. মেসার্স সামী এন্টারপ্রাইজের মালিক মো রাকিব হোসেন ওরফে রাকিব; ২. মো. মাসুদ রানা সিনিয়র নিরাপত্তা প্রহরী; ৩. ওয়াসিম, নিরপত্তা প্রহরী, ৪ . আবুল কালাম আজাদ সিনিয়র নিরাপত্তা প্রহরী, ৫, মাসুদুল হক সিনিয়র নিরাপত্তা প্রহরী, ৬. প্রকৌশলী রতনচন্দ্র দে, উপমহাব্যবস্থাপক, ৭ রকিব উদ্দিন সরদার ব্যবস্থাপক, ৮. মোঃ রেজাউল করিম খান উপব্যবস্থাপক, ৯. মোঃ মহিউদ্দিন জাবেদ, উপসহকারী প্রকৌশলী, ১০. মোঃ রজব আলী উপব্যবস্থাপক। এ ছাড়া আট থেকে দশজন অজ্ঞাতনামা আসামি রয়েছে।
রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন গ্যাস বিতরণ কোম্পানি তিতাসের নতুন সংযোগ ছয় বছর ধরে বন্ধ থাকলেও অবৈধভাবে ঠিকই একটি চক্র গ্যাস সংযোগ দিয়ে আসছে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে বাড্ডা জোনে হঠাৎ করেই বেড়ে যায় ১ হাজার ২৪৭ চুলা। সেগুলোকে আবার রাতের আঁধারেই তিতাসের সেন্ট্রাল সার্ভারে যুক্ত করে দেওয়া হয় বৈধতার জন্য। তবে বিষয়টি ধরা পড়ে যায় তিতাস কর্তৃপক্ষের কাছে। বিষয়টি নিয়ে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শুধু বাড্ডা নয়, ঢাকা মেট্রো বিপণন ডিভিশন উত্তর ও দক্ষিণ, এমনকি আঞ্চলিক বিপণন ডিভিশন গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জেও কর্মকর্তাদের জোগসাজশে অবৈধ গ্যাস সংযোগের প্রবণতা বেড়েছে।
বিশেষ করে সার্ভারে ঢুকে পড়াকে কেন্দ্র করে তিতাস কর্তৃপক্ষের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে যায়। পরে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে দেয় তিতাসের বর্তমান ব্যবস্থাপক। তদন্ত কমিটি দীর্ঘ তদন্ত শেষে কর্মকর্তা কর্মচারীদের দায়ী থাকার প্রমাণ পায়। তদন্ত কমিটির সুপারিশের প্রেক্ষিতে দুই মাস আগে অভিযুক্তদের চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।