ভারতের শাসক দল বিজেপি কেন তাদের একটি রাজনৈতিক প্রচারণার ভিডিওতে ধর্ষণের দৃশ্যে শিশুশিল্পীদের ব্যবহার করেছে, তা নিয়ে পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের করেছে পশ্চিমবঙ্গ শিশু অধিকার সুরক্ষা কমিশন।
সরকারি ওই কমিশনের চেয়ারপার্সন বিবিসিকে জানিয়েছেন, এভাবে শিশুদের ব্যবহার করাটা গুরুতর আইন ভঙ্গ করার সামিল, এবং সে জন্যই তারা গোটা ঘটনার পুলিশি তদন্ত চেয়েছেন। খবর বিবিসি বাংলার
বিজেপি অবশ্য দাবি করেছে, পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক বাস্তবতাই এমন যে শিশুরাও ওখানে সুরক্ষিত নয় – আর সেই সত্যিটা তুলে ধরতেই ভিডিওতে শিশুশিল্পীরা অভিনয় করেছে।
বিজেপির প্রস্তুত করা যে রাজনৈতিক প্রচারণামূলক ভিডিওটি নিয়ে এ বিতর্ক, তা দলের পশ্চিমবঙ্গ শাখার পক্ষ থেকে ফেসবুকে পোস্ট করা হয়েছিল গত শুক্রবার।
বীরভূমে জেলার সাঁইথিয়াতে বছরতিনেক আগে এক গৃহবধূকে তার বাচ্চা ছেলেমেয়ের সামনে ধর্ষণ করে হত্যা করা হয়েছিল, সেই ঘটনাটিরই পুননির্মাণ করা হয় ওই ভিডিওতে।
ছবিতে আলো-আঁধারির মধ্যে দেখা যায়, দুটি বাচ্চা ছেলেমেয়ের সামনেই তাদের মায়ের ওপর পাশবিক অত্যাচার চালাচ্ছে একদল লোক।
এই ভিডিও সামনে আসার পরই তীব্র আপত্তি জানায় পশ্চিমবঙ্গ শিশু অধিকার সুরক্ষা কমিশন।
কোন আইন ভেঙেছে এই ভিডিও?
কলকাতার পুলিশ কমিশনার অনুজ শর্মাকে চিঠি লিখে কমিশনের চেয়ারপার্সন অনন্যা চট্টোপাধ্যায় অভিযোগ জানান, ২০১২ সালের পকসো বা প্রোটেকশনস অব চিল্ড্রেন ফ্রম সেক্সুয়াল অফেন্সেস আইন এবং জুভেনাইল জাস্টিস অ্যাক্ট (জেজেএ) – দুটোই ভেঙেছেন এই ভিডিওর নির্মাতারা।
অনন্যা চট্টোপাধ্যায় বলছিলেন, আমরা অভিযোগ করেছি কারণ এখানে একটা সেমি-পর্নোগ্রাফিক দৃশ্যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বাচ্চাদের ব্যবহার করা হয়েছে।
এটা পকসো এবং জেজেএ তো বটেই, সেই সঙ্গে ইউএনসিআরসি – অর্থাৎ জাতিসংঘের কনভেনশন অন দ্য রাইটস অব দ্য চাইল্ডেরও লঙ্ঘন।
এই ধরনের সেক্সুয়াল ভায়োলেন্সের দৃশ্যের শুটিংয়ে যদি অল্পবয়সী বাচ্চাদের ব্যবহার করা হয় তাহলে তাদের মনের ওপর সাঙ্ঘাতিক বিরূপ প্রভাব পড়ে।
তিনি বলেন, এক তো, বাচ্চারা ভীষণ ভয় পেয়ে যেতে পারে। তা ছাড়া পুরো ঘটনাটা আত্মস্থ করে সে নিজেকে দিয়েও পুরো ঘটনাটা ভবিষ্যতে রেপ্লিকেট করারও চেষ্টা করতে পারে।
কিন্তু যৌন সহিংসতার দৃশ্যে শিশুদের ব্যবহার তো আজকাল ওয়েব সিরিজ বা সিনেমাতেও আখছার হচ্ছে?
অনন্যা চট্টোপাধ্যায় জবাবে বলছেন, ওয়েব সিরিজে কখনও বাচ্চার সামনে রেপ করা হয়েছে বলে আমার চোখে পড়েনি। হয়তো বা মিস করে গেছি।
আর সিনেমাতেও যদি কখনও এমন দৃশ্য তৈরি হয়ে থাকে যে শিশুদের সামনে মা-কে ধর্ষণ করা হয়েছে, কিংবা ওয়েব সিরিজেও – তাহলে সেটাও কিন্তু দন্ডনীয় অপরাধ!
তিনি বলেন, কিন্তু সিনেমা বা ওয়েব সিরিজ তো কেন্দ্রের এক্তিয়ারে পড়ে, আমরা শুধু পশ্চিমবঙ্গের ঘটনা নিয়েই ব্যবস্থা নিতে পারি।
এই ঘটনাটি পশ্চিমবঙ্গের বলেই কমিশন ভিডিও নির্মাতার নাম-পরিচয় জানতে চেয়েছে, শিশুদের ওই দৃশ্যে ব্যবহারের আগে তাদের অভিভাবকদের অনুমতি নেওয়া হয়েছিল কি না সেটাও পুলিশকে খতিয়ে দেখতে বলেছে।
নির্ভয়া ধর্ষণের পুননির্মাণও তো হয়েছে
তবে বিজেপি নেতৃত্ব অবশ্য এই সব আপত্তিকে একেবারেই আমল দিতে রাজি নন।
পশ্চিমবঙ্গের রায়গঞ্জ থেকে নির্বাচিত বিজেপি এমপি ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী দেবশ্রী চৌধুরী যেমন বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, পশ্চিমবঙ্গে তিন থেকে তিরাশি বছর বয়সী কেউই নিরাপদ নন বলেই এই ভিডিওতে তারা সেই বাস্তবটা তুলে ধরেছেন।
দেবশ্রী চৌধুরী বলছেন, এই রাজ্যে শিশুরাই তো রোজ ধর্ষণের শিকার। অথচ তার জন্য রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর কোনও শোক, হতাশা বা কোনও প্রতিক্রিয়াই নেই!
এই তো কিছুদিন আগেই একটি অল্পবয়সী মেয়েকে তার বাড়ির ছাদে দুষ্কৃতীরা ধর্ষণ করে গেল। তার মা আটকাতে গিয়ে নৃশংসভাবে প্রাণ দিলেন।
কাজেই পশ্চিমবঙ্গের ওই বাস্তব পরিস্থিতি তুলে ধরতেই ভিডিওটা ওভাবে শ্যুট করা হয়েছে।
আর যখন এ ধরনের কোনও ঘটনা ঘটে, দিল্লির নির্ভয়ার ঘটনাই ধরুন – এ ধরনের ঘটনা তো সিনেমা, সিরিয়ালে পুননির্মাণ করা হয়, আর মানুষ তাদের ক্ষোভ-আক্রোশ-অনুভূতিও সোশ্যাল মিডিয়াতে তুলে ধরেন।
দেবশ্রী চৌধুরী বলেন, কই তখন তো কেউ বলেন না যে এত পৈশাচিক ঘটনা কেন ফিল্মে তুলে ধরা হচ্ছে? ফলে এখন কেন এটা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে?
পুলিশের তরফে এ নিয়ে কৈফিয়ত তলব করা হলে দলের আইনজীবীরাই তার জবাব দেবেন বলে বিজেপির পক্ষ থেকে জানানো হচ্ছে।
আর পশ্চিমবঙ্গ শিশু অধিকার সুরক্ষা কমিশন বলছে, তারা পুলিশকে পাঁচ দিনের সময় দিয়েছেন – যে সময়সীমা শেষ হবে বুধবার।
বুধবারের মধ্যে বিজেপির বিরুদ্ধে পুলিশ কী ব্যবস্থা নেয়, সেটা দেখেই তারা পরবর্তী পদক্ষেপ নেবেন।