
ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি (বহিষ্কৃত) ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট তার ক্যাসিনো কারবার, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও দখলবাজিতে যারা মদদ দিয়েছেন, এসব অবৈধ কর্মকান্ডের ভাগ যারা নিয়েছেন তাদের সবার নাম ফাঁস করে দিচ্ছেন। গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) ও র্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে এমন পাঁচ সহযোগীর নামও বলেছেন সম্রাট। একই সাথে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সহসভাপতি (বহিষ্কৃত) এনামুল হক আরমানও জিজ্ঞাসাবাদে চমকপ্রদ নানা তথ্য দিচ্ছেন বলে জানিয়েছেন র্যাব ও ডিবির দুই কর্মকর্তা।
গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে ডিবির হেফাজতে থাকা সম্রাট ও আরমানকে র্যাব-১-এর কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে র্যাবের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তাদের পৃথকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করেন।
গত ১৮ সেপ্টেম্বর রাজধানীতে ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরুর পর সবচেয়ে আলোচিত যুবলীগ নেতা সম্রাট ও তার সহযোগী আরমানকে ৭ অক্টোবর কুমিল্লা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর ঢাকায় তার বাসা ও কার্যালয়ে অভিযান চালিয়ে অস্ত্র ও মাদক উদ্ধার করে র্যাব।
এ ঘটনায় সম্রাটের বিরুদ্ধে রমনা থানার দুই মামলায়ই আরমানকে সহযোগী হিসেবে আসামি করা হয়। এদিকে গ্রেপ্তারের সময় আরমানকে মদ্যপ অবস্থায় পাওয়ায় কুমিল্লায় তাকে ছয় মাসের কারান্ড দেয় ভ্রাম্যমাণ আদালত। অস্ত্র ও মাদক আইনের মামলায় সম্রাট ও আরমানকে গত ১৫ অক্টোবর ৫ দিন করে ১০ দিনের রিমান্ডে নেওয়ার অনুমতি পায় পুলিশ।
মামলা দুটি ডিবি থেকে র্যাবের কাছে যাওয়ার প্রসঙ্গে গতকাল পুলিশ সদর দপ্তরের এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ক্যাসিনো কারবারের অভিযানগুলো মূলত র্যাবই করেছে। তারা আসামি গ্রেপ্তার করছে; মামলা করছে। এখন রিমান্ডে নেওয়া হচ্ছে আসামিদের। যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ ভূইয়া ও যুবলীগ নামধারী ঠিকাদার জি কে শামীমকে রিমান্ডে নেওয়ার প্রথম থেকেই তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে ডিবি। ক্যাসিনো কারবারিদের জিজ্ঞাসাবাদ ও তদন্ত করতে সম্প্রতি পুলিশ সদর দপ্তরে আবেদন করেছে র্যাব। ওই আবেদনটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। পরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় র্যাবকে তদন্ত ও জিজ্ঞাসাবাদের নির্দেশ দেয়। ওই নির্দেশ পেয়েই শামীম ও খালেদকে র্যাব জিজ্ঞাসাবাদ করে। সেই আলোকেই সম্রাট ও আরমানকে ডিবির হেফাজত থেকে তাদের হেফাজতে নিয়েছে র্যাব। তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যেকোনো সংস্থাই জিজ্ঞাসাবাদের জন্য যে কাউকে নিতে পারে।
এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবহিত করতে হয়। তদন্তকারী সংস্থার একাধিক কর্মকর্তা বলেন, গত মঙ্গলবার অস্ত্র ও মাদক মামলায় ১০ দিনের রিমান্ডে নেওয়ার পর ডিবির হেফাজতে নেওয়া হয় সম্রাট ও আরমানকে। সেদিন রাতভর তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে ডিবির একটি টিম। দুজনকে আলাদাভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। ডিবির এক কর্মকর্তা জানান, গত বুধবার এবং গতকাল সকালেও তারা কয়েক দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করেন সম্রাট ও আরমানকে। আরমানের কাছ থেকে যেসব উত্তর পাওয়া গেছে সেগুলো সম্রাটের তথ্যের সঙ্গে খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
তিনি বলেন সম্রাটকে প্রশ্ন করলে, হঠাৎ সম্রাট বলতে থাকেন সব দোষ কি শুধু আমার। আমাকে যারা আজ সম্রাট বানানোর পেছনে কাজ করেছেন তাদের তো ধরা হচ্ছে না। আমি কার না উপকার করেছি। সবাইকেই আমি অর্থ দিয়েছি।
আ.লীগ ও তার অঙ্গ সংগঠনের শীর্ষ নেতা থেকে শুরু করে মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীদের নিয়মিত অর্থ দিয়েছি। ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, সম্রাট বলেছেন, বিভিন্ন সংগঠন অনুষ্ঠান করলে সেখানে আমি অনুদান দিয়েছি। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর কতিপয় কর্মকর্তাকে নিয়মিত অর্থ দিতে হয়েছে। আজ আমি বড় ধরনের অপরাধ করে ফেলেছি। হ্যাঁ, আমার জুয়া খেলার অভ্যাস ছিল। জুয়ার আসর থেকে যে অর্থ আসত সবার মধ্যে বিলিয়েছি। দেশের বাইরে গিয়ে ক্যাসিনো খেলতাম। পার্টির জন্য অর্থ খরচ করেছি। মিছিল সমাবেশে যাওয়ার জন্য কর্মীদের অর্থ দিতে হয়েছে।
র্যাবের এক কর্মকর্তা বলেন, গতকাল দুপুরে ডিবির কাছ থেকে সম্রাট ও আরমানকে তাদের হেফাজতে নেওয়া হয়। পরে র্যাবের কয়েকজন কর্মকর্তা দুজনকে জেরা করেন। তবে সম্রাটকে সাবধানে জেরা করতে হচ্ছে। কারণ তিনি অসুস্থ। তার পেসমেকার বসানো আছে। আদালতও বলেছে সতর্কভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করতে। এক প্রশ্নের জবাবে ওই র্যাব কর্মকর্তা বলেন, বিভিন্ন অপকর্মের আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতাদের ব্যাপারে বেশকিছু তথ্য দিচ্ছেন তারা। তথ্যগুলো আমরা যাচাই-বাছাই করছি।
পুলিশ সদর দপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, সম্রাট ও আরমান তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতা হিসেবে যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতার কথা বলেছেন। তাছাড়া রিমান্ডে থাকার সময় খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া ও জি কে শামীমও ওসব নেতার ব্যাপারে তথ্য দিয়েছিলেন। ওইসব নেতার মধ্যে স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট মোল্লা আবু কাউসার, পুরান ঢাকার বিএনপি নেতা রিয়াজউদ্দিনের নাম রয়েছে। তাদের ব্যাপারে আমরা খোঁজ-খবর রাখছি। তারাসহ অনেকেই ক্যাসিনোর কারবারে জড়িত। সরকারের ‘গ্রিন সিগন্যাল’ পেলে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) এক কর্মকর্তা বলেন, শুরু থেকেই সম্রাট ও আরমানের রিমান্ডকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। প্রথম দিনই ডিবির উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে একটি টিম সম্রাট ও আরমানকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। শিগগিরই তাদের জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেলে মুখোমুখি (জেআইসি) জিজ্ঞাসাবাদ করার প্রস্তুতি ছিল ডিবির।
এর মধ্যেই মামলা হস্তান্তর করা হয়েছে র্যাবে। ইতিমধ্যে ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে গুরুত্বপূর্ণ অনেক তথ্য দিয়েছেন সম্রাট। তিনি আরও বলেন, সম্রাট আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের শীর্ষ স্থানীয় এক ডজনেরও বেশি নেতার নাম প্রকাশ করেছেন। যারা নিয়মিত তার কাছ থেকে টাকার ভাগ নিয়েছেন। সম্রাটের কাছ থেকে সুবিধা নিয়েছেন এরকম কয়েক পুলিশ কর্মকর্তার নামও রিমান্ডে পাওয়া গেছে। বিষয়টি নিয়ে পুলিশ প্রশাসন বিব্রত।