
উজান হতে নেমে আসা ব্রহ্মপুত্র, ঘাঘট ও তিস্তাসহ গাইবান্ধার নদ-নদীর পানি কমতে শুরু করেছে। তবে নদ-নদীর পানি কমলেও এখনো বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। নতুন করে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি না হলেও বানভাসি মানুষের দুর্ভোগ কমেনি। এখনও পানিবন্দি রয়েছে প্রায় চার লাখ মানুষ। অনেকে বাড়িতে ফিরতে পারেনি। বাঁধ ও উঁচু স্থানসহ জেলার ১শ’ ৬৬টি আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নেওয়া এসব মানুষ এখনও মানবেতর জীবনযাপন করছে। বিভিন্ন স্থানে দেখা দিয়েছে খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকট। সেইসাথে রয়েছে স্যানিটেশনের বিড়ম্বনা। বানভাসি মানুষ খোলা আকাশের নিচে বসবাস করছে। এছাড়া বন্যাকবলিত এলাকার মানুষ সবথেকে বেশি ভোগান্তি পোহাচ্ছে গবাদি পশু নিয়ে। গবাদি পশুর থাকা এবং খাবার চরম সংকট দেখা দিয়েছে। পানিতে তলিয়ে থাকা রাস্তা-ঘাট, ঘর-বাড়ি, স্কুলগুলো এখনো ব্যবহারের উপযোগী হয়নি। বন্যায় জেলার সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ায় অনেক স্থানে সরকারি ত্রাণ পৌঁছেনি ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের কাছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সুত্রে জানা গেছে, শনিবার (২০ জুলাই) সকাল ৬টা পর্যন্ত ফুলছড়ির তিস্তামুখ ঘাট পয়েন্টে ব্রহ্মপুত্র নদের পানি ১১ সে.মি. কমে বিপদসীমার ১৩২ সে.মি., ঘাঘট নদীর পানি ১৩ সে.মি. কমে শহরের নতুন ব্রীজ পয়েন্টে বিপদসীমার ৮৪ সে:মি: এবং করতোয়া নদীর পানি বিপদসীমার ২ সে.মি. উপর দিয়ে বইছে। তবে সুন্দরগঞ্জ উপজেলার হরিপুর পয়েন্টে তিস্তা নদীর পানি কমে বিপদসীমার ৫০ সে:মি: নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
এদিকে নদ-নদীর পানি কমতে শুরু করলেও ইতোমধ্যে ব্রহ্মপুত্র ও ঘাঘট নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের অন্তত ছয়টি পয়েন্টসহ গাইবান্ধা পানি উন্নয়ন বোর্ডের সবগুলো বাঁধ ভেঙ্গে বানের জলে প্লাবিত হয়ে পড়ে জেলার পাঁচ উপজেলাসহ গাইবান্ধা পৌরসভা। পৌরসভার প্রায় সবগুলো ওয়ার্ড বন্যার পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। ফলে সীমাহীন দুর্ভোগে পড়েছেন পানিবন্দি পৌরবাসী। এজন্য তারা পানি উন্নয়ন বোর্ডের খামখেয়ালীপনা ও উদাসীনতাকে দায়ী করছেন। শুষ্ক মৌসুমে বাঁধগুলোর রক্ষণাবেক্ষন, তদারকি ও সংস্কার না করায় বাঁধ ভেঙ্গে যাবার মতো ঘটনা ঘটেছে বলে মনে করছেন তারা। ১৯৮৮ সালের স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যাকে ছাড়িয়ে এবারের বন্যাকে মহাপ্লাবন বলে আখ্যায়িত করছেন গাইবান্ধার বানভাসী মানুষ।
এছাড়া শুক্রবার ভোরে গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার মহিমাগঞ্জ ইউনিয়নের চরবালুয়া কাটাখালী নদী রক্ষা বাঁধ ভেঙ্গে মহিমাগঞ্জ, কোচাশহর, শালমারাসহ উপজেলার নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। ভেঙে গেছে বাঁধসহ রাস্তাঘাট। এনিয়ে জেলায় বন্যা ক্ষতিগ্রস্থ উপজেলার সংখ্যা দাড়ালো ৬টিতে।
জেলা প্রশাসনের দেওয়া তথ্যানুযায়ী গাইবান্ধা সদর, সুন্দরগঞ্জ, ফুলছড়ি, সাঘাটা, ও সাদুল্লাপুর উপজেলার ৩৭টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভাসহ ২৫৩টি গ্রামের ১ লাখ ৪ হাজার ৩৪০টি পরিবারের অন্তত ৪ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৩৯ হাজার ১৪২টি। বন্যা কবলিত মানুষের আশ্রয়ের জন্য ১৬৬টি আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এতে আশ্রয় নিয়েছে ৭১ হাজার ২৪ জন। বন্যা কবলিত এলাকার রাস্তাঘাট সব ডুবে গিয়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছে কাঁচা রাস্তা ৫১৭ কি.মি., পাকা রাস্তা ১৮৭ কি.মি., ১৮টি কালভার্ট এবং ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৫৭.৫০ কিলোমিটার বাঁধ। এদিকে বিভিন্ন ফসল পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে ৯ হাজার ৮২১ হেক্টর। এছাড়া ২ হাজার ৯৪১টি পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে ২ হাজার ৬৪০ টি টিউবওয়েল। বন্যা কবলিত এলাকায় কাজ করছে ৭৫ টি মেডিকেল টিম।
বন্যার পানিতে ডুবে ও সাপের কামড়ে মারা গেছে ২ জন। এ পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত ওই ৫ উপজেলায় জেলা ত্রাণ ভান্ডার থেকে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ১ হাজার মে. চাল ও ১৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা এবং ৬ হাজার কার্টুন শুকনা খাবার। ওইসব সামগ্রী ইতোমধ্যে ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে বিতরণের কাজ চলছে।
গাইবান্ধা জেলা প্রশাসন ইতোমধ্যে বন্যা কবলিত এলাকাগুলোতে ত্রান সহায়তা দেয়া শুরু করেছে। বন্যাকবলিত এলাকাগুলোর জন্য এখন পর্যন্ত ৫৮৫ মেট্রিকটন চাল, নগদ ৯ লাখ টাকা ও ৩ হাজার ৫৫০ কার্টুন শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে।
