
আন্তর্জাতিক ডেস্ক
নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্ট চার্চে নামক শহরে মুসলিমদের দুটো মসজিদে হামলার পর দেশটি এখন এর ধকল কাটিয়ে উঠতে চেষ্টা করছে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের মুসলিম সমাজ দেশটিতে দিন দিন ধর্মান্ধতা বৃদ্ধির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়ার জন্য দেশটির সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের মুসলিমরা রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, স্থানীয় কর্মকর্তাবৃন্দ সহ বিভিন্ন প্রযুক্তি কোম্পানি সমূহের প্রতি আকুতি জানিয়েছে। তাদের এরকম আহ্বান জানানোর কারণ হচ্ছে সাম্প্রতিক সময়ে দেশটিতে বর্ণবাদ এতই বেড়ে গিয়েছে যে, যার ফলে বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে হামলা চালিয়ে বেশ কিছু ধর্মপ্রাণ মানুষ জনদের হত্যা করা হয়েছে।
শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসি শহরে অনুষ্ঠিত ‘Council on American-Islamic Relations’ এর নির্বাহী পরিচালক নিহাদ আওয়াদ নিউজিল্যান্ডের হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের জোরালো ভূমিকা রাখার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন।
তিনি বলেন এ বিষয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বক্তব্য ‘বিশ্বব্যাপী নিরীহ জনগণের জীবনযাত্রার উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলবে।’
তিনি আরো বলেন, ‘একে শুধুমাত্র একটি ঘৃণামূলক আক্রমণ বলা আপনার জন্য উচিত হবে না, আপনার একে শ্বেতাঙ্গবাদী সন্ত্রাসী আক্রমণ বলা উচিত।’
‘মুসলিম, কৃষ্ণাঙ্গ, ইহুদি এবং অভিবাসীদের কে আপনার উচিত এই নিশ্চয়তা প্রদান করা উচিত যে, আমরা সকলেই সুরক্ষিত। একই সাথে আপনার এও বলা উচিত যে, আপনি অভিবাসী এবং সংখ্যালঘুদের ওপর যেকোনো ধরনের শারীরিক আঘাত সহ্য করবেন না। এবিষয়ে আপনার পরিষ্কার বক্তব্য রাখা উচিত।’
নিউজিল্যান্ডের সন্দেহভাজন হামলাকারী বর্তমানে পুলিশ হেফাজতে রয়েছে, সে মসজিদে হামলা করার সময় পুরো হামলার দৃশ্য ফেইসবুকে লাইভ করেছিল। তার ওই হামলায় অন্তত ৫০ জন নিহত এবং ৪৮ জন গুরুতর আহত হয়েছে।
অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক এই হামলাকারী নিজেকে ২৮ বছর বয়সী একজন যুবক বলে পরিচয় দিয়েছে এবং দাবী করেছে যে, সে অভিবাসীদের বিরুদ্ধে ইউরোপ এবং শ্বেতাঙ্গদের যুদ্ধের প্রতিনিধিত্ব করে।
নিহাদ আওয়াদ ট্রাম্পের উদ্দেশ্য বলেন, ‘আপনার নির্বাচনী প্রচারণায় ইসলামোফোবিয়া চরম মাত্রায় পৌঁছিয়েছিল এবং নিরপরাধ মুসলিম আর অভিবাসীদের উপর ব্যাপক হামলা চালানো হয়েছিল।’
যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক অধিকার সম্পর্কিত একটি সংগঠনের নির্বাহী পরিচালক ফারহানা খেরা এক বিবৃতি বলেন, মুসলিম বিরোধী ধর্মান্ধতা এবং ঘৃণা মূলক আক্রমণ বর্তমানে ইতিহাসের যেকোনো সময়ের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে।
অধিকন্তু, বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া যেমন ফেইসবুক, টুইটার, গুগোল ইত্যাদি ব্যাবহার করে ঘৃণা চড়ানো দল সমূহ সংঘাত উস্কে দেয়। তারা এসব ব্যাবহার করে সদস্য সংগ্রহ করে। ফলে এসমস্ত সোশ্যাল মিডিয়ার উচিত এদের কে চিহ্নিত করা এবং তাদের কন্টেন্ট সমূহ বন্ধ করে দেয়া।
এদিকে হামলার ভিডিও ছড়িয়ে পড়ার কিছুক্ষণের মধ্যে ফেইসবুক থেকে তা মুছে ফেলতে কর্তৃপক্ষ সচেষ্ট হয় এবং একই সাথে ফেইসবুক এবং ইনস্টাগ্রাম থেকে হামলাকারীর সকল একাউন্ট বন্ধ করে দেয়া হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটর মার্ক ওয়ার্নার ওয়াশিংটন পোষ্টকে বলেন, ‘হামলার এই ঘৃণা মূলক ভিডিও এত দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে ফেইসবুকের কল্যাণে। একই সাথে তা ইউটিউব এবং রেডডিটে আপলোড হচ্ছে। এর মাধ্যমে একটি বিষয় পরিষ্কার হয়েছে তা হচ্ছে, কত সহজে এত বড় প্লাটফর্মে গুলোকে খারাপ ভাবে ব্যাবহার করা যায়।’
এক বিবৃতিতে ইউটিউব এবং টুইটার কর্তৃপক্ষ হামলার নিন্দা জানিয়েছে এবং তারা হামলার ভিডিও চিত্র সমূহ সরিয়ে ফেলার জন্য কাজ করছে বলেও জানিয়েছে।
ট্রাম্পের শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদ
গত শুক্রবার গণমাধ্যম কর্মীদের সাথে আলোচনা কালে শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদকে বৃদ্ধি পেতে থাকা বৈশ্বিক হুমকির কারণ হিসেবে উল্লেখ করতে অস্বীকার করেছেন।
ট্রাম্প বলেন, ‘আমি মনে করি কিছু ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী রয়েছে যারা গুরুতর সমস্যা সৃষ্টি করে। আমি মনে করি আপনি যদি নিউজিল্যান্ডে যা হয়েছে তার দিকে তাকান তবে এর মর্ম বুঝতে পারবেন। আমি এর সম্পর্কে এখনো বেশী কিছু জানিনা। কিন্তু নিশ্চিত ভাবে এটি একটি ভয়ঙ্কর ঘটনা।’
শুক্রবারের সালাত
গত শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রের মসজিদ সমূহে সালাত আদায় করতে আসা মুসলিম গণ নিউজিল্যান্ডের হৃদয় বিদারক ঘটনায় শোক প্রকাশ করেছেন।
অন্যান্য দিনের তুলনায় বেশি জনসমাগম হওয়ায় নিউইয়র্ক শহরের ‘Islamic Cultural Center’ তাদের সকল দরজা সমূহ খুলে দিয়েছিল এবং রাস্তায় কার্পেট ছড়িয়ে দিয়েছিল।
কানাডার টরেন্টো শহর থেকে আসা রিম এলসোবকি নামের একজন নারী ডাক্তার বার্তা সংস্থা এনপিআর কে বলেন, নিউজিল্যান্ডের এমন হৃদয় বিদারক ঘটনার পরে মসজিদে এসে সালাতে একত্রিত হওয়াটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
তিনি বলেন, ‘আমরা এটি দেখাতে চাই যে, আমরা আমাদের প্রার্থনা স্থলে আসতে ভীত নই।’
‘যখন প্রার্থনা করা হয় তখন সকলেরই নিরাপদ অনুভব করা উচিত।’
রিম এলসোবকি ২০১৭ সালে কানাডায় ঘটে যাওয়া একটি হামলা সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করেন। ২০১৭ সালে কানাডার কুইবেক শহরের একটি মসজিদে বন্দুকধারী একজন ব্যক্তি নির্বিচারে হামলা চালিয়ে বেশ কয়েকজন মুসলিমকে হত্যা করে।
নিউইয়র্ক শহরে গাড়ি চলান বুরজান উগরুয়াল নামের এক মুসলিম। তিনি বলেন, নিউজিল্যান্ডের মসজিদে হামলাকারীকে অবশ্যই একজন সন্ত্রাসী হিসেবে দেখা উচিত।
তিনি বলেন, ‘সন্ত্রাসীর কোনো জাতীয়তা নেই। সন্ত্রাসীর কোনো ধর্ম নেই। এটি ‘ইসলামিক সন্ত্রাস’, এটি ‘ক্যাথলিক সন্ত্রাস’ এরকমটি বলার কারো অধিকার নেই।’
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের মসজিদ সমূহের বাহিরে বিভিন্ন ধর্মের নের্তৃবৃন্ধ আগত মুসলিমদের সাথে সমবেদনা জানানোর জন্য এগিয়ে এসেছিলেন।
ইহুদি রাব্বি ইলিয়ট কোসগ্রোভ হাতে করে বিশাল একটি ফুলের তোড়া নিয়ে এসেছিলেন। তিনি গত বছর যুক্তরাষ্ট্রের পিটসবার্গে একটি ইহুদি উপাসনালয়ে হামলার কথা স্মরণ করেন।
তিনি বলেন, ‘ইহুদি কমিউনিটি পিটসবার্গের হামলার কথা এখনো মনে করে। এর মাধ্যমে আমরা আপনাদের সাথে সমবেদনা জানাতে চাই।’

যুক্তরাষ্ট্রের ‘Federal Trade Commission’ এর একজন চুক্তি কারক সিরিয়ান বংশোদ্ভূত এমাদ আলসাগহের বলেন, ‘একটি শান্তিপূর্ণ দেশে যেখানকার লোকজন যুদ্ধের মধ্যে নেই সেখানে এমন একটি হামলা হতে পারে এমনটি আমি আশা করি নি।’
তিনি বলেন, ‘আমি সিরিয়া ছেড়েছি কারণ সেখানে প্রতিনিয়ত বোমার আঘাত সহ্য করতে হয়। আমি সেখানে খুব খারাপ পরিস্থিতির মধ্যে ছিলাম। আমি অনেক হৃদয় বিদারক ঘটনার সাক্ষী। কিন্তু এটি ছিল সবচেয়ে অভিঘাত কেননা আমি এই হামলার ভিডিওটি দেখার জন প্রস্তুত ছিলাম না।’
উচ্চমাত্রার নিরাপত্তা
ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ‘Homeland Security’ এর সচিব ক্রিস্টজেন নেইলসেন বলেছেন, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের মুসলিম কমিউনিটির উপর হামলার কোনো আশংকা নেই। এর পরেও কর্মকর্তারা দেশের সকল মসজিদে নিরাপত্তা জোরদার করেছে।
নিউইয়র্কের সকল মসজিদ সহ অন্যান্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান সমূহে নিউইয়র্ক পুলিশের সন্ত্রাস বিরোধী বিভাগে ভারী অস্ত্র শস্ত্র সহ নিরাপত্তার কাজে নিয়োজিত হয়েছে।
নিউইয়র্ক শহরের পুলিশ কমিশনার জেমস ও’ নিল এক বিবৃতিতে বলেন, ‘নিউইয়র্কের মুসলিম কমিউনিটির প্রতি: আমরা সবসময় আপনাদের সাথে রয়েছি একই সাথে আপনাদের নিরাপদ রাখার জন্য আমরা সজাগ থাকবো এবং আপনারা যাতে নিরাপদ অনুভব করেন এ বিষয়টি নিশ্চিত করবো।’
সূত্র: এনপিআর ডট ওআরজি।