
১৯৭১ সালে জীবনবাজী রেখে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করলেও, সেই যোদ্ধা মজনু মিয়া এখন গুচ্ছগ্রামে বসবাস করছেন। ৭১’এ মজনু মিয়া ছিলেন টগবগে একজন যুবক। সেই সময় দেশটা ছিল উত্তাল। পাকিস্থানীদের শোষনের বিরুদ্ধে রুখে দাড়িয়েছিলেন এদেশের আপামর জনগণ। ঠিক তখনই মজনু মিয়া জীবনের মায় ত্যাগ করে স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তার অদম্য সাহস আর দেশপ্রেমে তিনি হয়ে ওঠেন এক মুক্তিযোদ্ধা। গাইবান্ধা জেলার সাদুল্লাপুর উপজেলার বনগ্রাম ইউনিয়নের জয়েনপুর গ্রামের মৃত খবির উদ্দিনের ছেলে মজনু মিয়া। তার বয়স এখন প্রায় ৬৪ বছর। বসতভিটা হারিয়ে বর্তমানে তিনি জয়েনপুরস্থ একটি গুচ্ছগ্রামে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে যুদ্ধকালীন ১১নং সেক্টরে মজনু মিয়ার সহযোদ্ধা হিসেবে ছিলেন-আবেদ আলী, সুলতান গিয়াস ও আলতাফ হোসেন। এই অমিত সাহসী বীর মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে অনেক সফল অভিযানে অংশ নিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক মুহম্মদ আতাউল গনি ওসমানী স্বাক্ষরীত সনদপত্র পান মজনু মিয়া। যার সনদ নম্বর ১৬৫৮৮৫। অতি দুঃখের বিষয় যে, মজনু মিয়া স্বাধীনতা সংগ্রামের সনদ পেলেও, এখন পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাননি এই মুক্তেযোদ্ধা । সেই সময়ে জীবনবাজী রেখে দেশ স্বাধীন করলেও, জীবনযুদ্ধে তিনি আজ পরাজিত সৈনিক। মজনু মিয়ার জায়গা জমি না থাকায় বর্তমানে তিনি সাদুল্লাপুর উপজেলার জয়েনপুরস্থ গুচ্ছগ্রামে ১১ বছর ধরে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। দেশ স্বাধীনের ৪৮ বছর পেরিয়ে গেলেও কোন সরকারি সুযোগ-সুবিধা কিংবা মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি পাননি বলে তার অভিযোগ। হাতে রয়েছে মুক্তিযোদ্ধের সেই সনদ ।
তিনি সাংবাদিকদের জানান, ভারতের কাকড়ীপাড়া প্রশিক্ষণ শিবিরের আজিম মাহবুর এর কাছে প্রশিক্ষণ গ্রহন করে নিজ জেলা গাইবান্ধার কামারজানি, কঞ্চিবাড়ী ও দক্ষিণ দূর্গাপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় ক্যাপ্টেন হামিদ উল্লার নেতৃত্বে ওইসব এলাকায় সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন তিনি। তার অধিনায়ক ছিলেন আব্দুল হামিদ পালোয়ান। এরপর ওই যুদ্ধে সফলভাবে অংশ গ্রহন করার ফলে মজনু মিয়াকে প্রত্যয়নপত্র দিয়েছেন- বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ গাইবান্ধা জেলা ইউনিটের সাবেক কমান্ডার নাজমুল আরেফিন তারেক, সাদুল্লাপুর উপজেলা ইউনিটের কমান্ডার মেছের উদ্দিন সরকার ও ইউপি চেয়ারম্যান শাহীন সরকার।
সেই যুদ্ধে অংশ গ্রহনকারী মজনু মিয়া যুদ্ধের সকল প্রমানপত্রাদি দিয়ে গেজেটধারী মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পেতে গত বছরে অনলাইন আবেদন করাসহ বিভিন্ন মাধ্যমে আবেদন করেন। এরই প্রেক্ষিতে সাদুল্লাপুর উপজেলা যাচাই-বাছাই কমিটি কর্তৃক মজনু মিয়াকে বাতিল করে “গ” তালিকা ভুক্ত করেন। ওই কমিটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন যে, মজনু মিয়ার সংগ্রামী সনদপত্র থাকলেও, ক্রমিক নম্বর নেই। এ কারণে তাকে বাতিল করা হয়েছে। অথচ ওই সনদপত্রের অপর পৃষ্ঠায় ক্রমিক নম্বর ছিল। যার নম্বর ১৬৫৮৮৫। তবুও মজনু মিয়াকে বাতিল করেছেন যাচাই-বাছাই কমিটি। বাধ্য হয়ে মজনু মিয়া জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলে আপীল আবেদন করেন। যার আবেদন নম্বর ২২০০৮। তিনি আপীল আবেদন করলেও অদ্যবধিও কোনো ফল পাননি। এরপর মাস দুয়েক আগে মজনু মিয়ার সনদের ক্রমিক নং ১৬৫৮৮৫ অর্ন্তভূক্তির জন্য ৩১, গাইবান্ধা-৩ আসনের সাংসদ ডা. ইউনুস আলী সরকার সাদুল্লাপুর ইউএনও’র নিকট ডিও লেটার দেন। ইউএনও রহিমা খাতুন ওই ক্রমিক নম্বর যাচাইয়ের জন্য সাদুল্লাপুর উপজেলা সমাজসেবা অফিসারকে দায়িত্ব দেয়। এরফলে মজনু মিয়ার যুদ্ধকালীন যাবতীয় কাগজপত্রাদি যাচাই-বাছাইকালে ক্রমিক নং ১৬৫৮৮৫ খুঁজে পায়। যার ফলে উল্লেখিতে ক্রমিক নম্বরটি অর্ন্তভূক্তকরণে ইউএনও রহিমা খাতুনকে একটি প্রতিবেদন ২৭ নভেম্বর/১৮ইং দাখিল করেছেন সমাজসেবা অফিসার মানিক চন্দ্র রায়। যার ডকেট নং ৭২৪ তারিখ ১৬/০৮/১৮ইং এবং স্মারক নং ৪১.০১.৩২৮২.০০০.০১১.০০১.১৮.২৩৯।
বর্তমানে এই যোদ্ধা পেটের তাগিদে স্ত্রী লাইলী বেগমকে নিয়ে অন্যের বাড়িতে শ্রম বিক্রি করে কোনমতে দিনাতিপাত করছেন। যেন থমকে গেছে তার জীবন। মজনু মিয়া দেশ স্বাধীন করে শুধুই পেয়েছে একটি সাটিফিকেট। শেষ বয়সে মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি পেয়ে মৃত্যুবরণ করতে চান, এটাই এখন মজনু মিয়ার আঁকুতি।