
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী অভিযোগ করে বলেছেন, সরকারের নির্দেশে নির্বাচন কমিশন (ইসি) ইলেক্ট্রিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) চালুর মাধ্যমে আরেকটি বড় ধরনের ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং এর পথে এগুচ্ছে।
বৃহস্পতিবার (১৯ জুলাই) সকালে রাজধানীর নয়াপল্টন দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেন তিনি।
রিজভী বলেন, যেহেতু সরকারের জনপ্রিয়তা নেই, সেজন্য তারা আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে নানা ফন্দিফিকির শুরু করেছে। ইভিএম সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিপন্থি। বাংলাদেশের ভোটাররা ইভিএম মানতে নারাজ। ভোটাধিকার হরণে এই পদ্ধতির ব্যবহার চুপিসারে ডিজিটাল অন্তর্ঘাত। সব মহলের আপত্তির পরও তাড়াহুড়ো করে নির্বাচন কমিশনের ইভিএম স্থানীয়ভাবে কেনা ও আমদানি করা দুরভিসন্ধিমূলক।
রিজভী বলেন, বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, নির্বাচন পর্যবেক্ষক ও বিশ্লেষকদের আপত্তির পরও তাড়াহুড়ো করে নির্বাচন কমিশনের ইভিএম স্থানীয়ভাবে কেনা ও আমদানি করা দুরভিসন্ধিমূলক, আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে চক্রান্তের পথে অগ্রসর হওয়ার অংশ। এই বিতর্কিত মেশিন নিয়ে কমিশনের কেনো এতো তোড়জোড় সেজন্য জনমনে গভীর সংশয় দানা বেঁধেছে। আমরা আগেও ইভিএম ব্যবহারের ত্রুটি নিয়ে দেশ-বিদেশের নানা দৃষ্টান্ত তুলে ধরেছিলাম, কিন্তু কমিশন সেটিকে পাত্তা না দিয়ে ক্ষমতাসীনদের প্রদর্শিত পথেই এগিয়ে যাচ্ছে। জনসমর্থনহীন বর্তমান অবৈধ সরকার ডিজিটাল জালিয়াতির জন্যই ইভিএম পদ্ধতি প্রচলন করতে নির্বাচন কমিশনকে দিয়ে এতো মরিয়া হয়ে উঠেছে।
বিভিন্ন দেশে ইভিএম ব্যবহার বন্ধ করা হয়েছে জানিয়ে বিএনপির শীর্ষ এই নেতা বলেন, সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনগুলো নিয়ে সফট ওয়ার প্রোগামাররা বলেছেন, ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিনগুলো বিদ্বেষমূলক প্রোগ্রামিংয়ের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ এবং যে কোনো মুহূর্তে হ্যাকাররা মেশিনটিকে হ্যাক করে ভোট গণনাকে খুব সহজেই টেম্পারিং করতে পারে। যদি অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচন হয়, তাহলে ব্যালট পেপারে ভোট গণনা সময় সাপেক্ষ বিষয় হলেও মানুষের এর ওপর পরিপূর্ণ আস্থা আছে। কারণ উচ্চ প্রযুক্তি সর্বদায় হ্যাকারদের আক্রমণ দ্বারা ভেদ্য হওয়ার ঝুঁকি সম্ভাবনা থাকে। বিরাট পরিবর্তনের ফলে প্রযুক্তির উৎকর্ষতা বাড়ার সাথে সাথে যতই তথ্য ধারণ করার ক্ষমতা বাড়ছে ততই ঝুঁকি ও বাড়ছে। কারণ একটি ভাইরাসই সমস্ত ধারণকৃত ডাটাকে ধ্বংস করে দিতে পারে।
রিজভী বলেন, এর আগে জার্মানি, আমেরিকা, ভারতসহ অনেক দেশে ইভিএম মেশিন নিয়ে বিতর্ক হওয়ায় এই মেশিন ব্যবহার বন্ধ আবার কোথাও সংস্কার করা হয়েছে, অনেক দেশে মামলাও হয়েছে। আমেরিকায় অনেক স্টেট বন্ধ করেছে আবার কিছু স্টেটে ইভিএমের পাশাপাশি ম্যানুয়াল পদ্ধতিও আছে। জার্মান আদালত ২০০৯ সালে এক রায়ে বলেছে, ইভিএম মেশিন খুব সহজেই টেম্পারিং করা সম্ভব। এতে ভোট পুনরায় গণনার সুযোগ নেই। তাই জার্মান আদালত ওই মেশিন ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে। গত বছর ভারতে কীভাবে ইভিএম পদ্ধতিতে ভোট কারসাজি হয়েছে, সেটি ছবিসহ প্রকাশ করা হয়েছে। বিবিসির সে সময়ের রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়-ভারতের মধ্য প্রদেশে ইভিএমের ভোটে ভোট দেওয়া হয় একজনকে, ভোট দিলে চলে যায় ক্ষমতাসীনদের প্রতীকে। সে সময় ভারতের বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল দেশটির নির্বাচনে ব্যবহৃত ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন বা ইভিএম নিয়ে প্রশ্ন তুলে।
তিনি বলেন, বিগত সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনকালে ফ্লোরিডা রাজ্যে এই ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিনের মাধ্যমে ভোট গণনায় সারা যুক্তরাষ্ট্রে ওঠে তীব্র নিন্দার ঝড়। বিশেষজ্ঞদের মতানুযায়ী ইভিএম পদ্ধতি ব্যবহারের মাধ্যমে নির্বাচনে অতি সহজেই ফলাফল পাল্টে ফেলা সম্ভব। কম্পিউটার বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করেছেন কিভাবে অপরাধীরা ইভিএম ‘হ্যাক’ করে অনায়াসে ভোট চুরি করতে সক্ষম। আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ও স্যান ডিয়াগো, মিশিগান ও প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ‘রিটার্ন ওরিয়েন্টেড প্রোগ্রামিং’ ব্যবহার করে ইভিএমকে দুর্ব্যবহার করার সক্ষমতা প্রমাণিত করেছেন। বিশেষজ্ঞদের সামনে তারা দেখিয়েছেন কিভাবে একটা ‘ভাইরাস’ ব্যবহারের মাধ্যমে ইভিএম মেশিনে হ্যাকাররা ভোটের ফলাফল সহজেই ‘ম্যানিপুলেট’ করতে পারে।
রিজভী বিশেষজ্ঞদের উদ্ধৃতি দিয়ে আরো বলেন, ইভিএমের একটি ক্ষুদ্র অংশ যার নাম Detectable Memory Module (DMM)। তার মধ্যেই নির্বাচনের ফলাফল সংরক্ষিত থাকে এবং এই অংশটি ইভিএম থেকে খুলে নেয়া যায় এবং এভাবে অতি সহজেই নির্বাচনের ফলাফলকে পাল্টে দেয়া সম্ভব। আয়ারল্যান্ড ২০০৬ সাল থেকে ইভিএম পদ্ধতি ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে। ২০০৯ সাল থেকে জার্মানি অসাংবিধানিক বলে ঘোষণা করেছে। ফিনল্যান্ডের সর্বোচ্চ আদালত ২০০৯ সালে মিউনিসিপ্যাল নির্বাচনে ব্যবহৃত ইভিএম-এর ফলাফল অবৈধ ঘোষণা করেছে। ২০০৪ সালে ক্যালিফোর্নিয়া ইভিএম-এর ব্যবহার নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। আর আমাদের সরকার এই অগ্রহণযোগ্য ও বিতর্কিত মেশিন ক্রয়ের ও ব্যবহারের জন্য কেন এত উন্মুখ তা বুঝতে কারোরই অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।
রিজভী বলেন, ইসি সাথে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজের সংলাপ চলাকালে ও পরবর্তীতে গণমাধ্যমের সামনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার একাধিকবার বলেছিলেন-জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার হবে না। কিন্তু হঠাৎ করে সেই পুরনো ভুত আবারো জেগে ওঠলো কেন? আসলে এই ইভিএম ব্যবহারে নির্বাচন কমিশনের মহা আয়োজনের কলকাঠিটি নাড়ছে বর্তমান অবৈধ সরকার। আজ্ঞাবাহী ইসি সরকারের নির্দেশের বাইরে এক ধাপ ফেলার ক্ষমতা নেই। হঠাৎ করে নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের প্রস্তুতিতে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে ভোটারদের আশার মুকুল এখন আস্তে আস্তে ঝরে যেতে বসেছে। আমরা আবারো জাতীয় নির্বাচনসহ সকল নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের জনদাবির বিপক্ষের সিদ্ধান্ত থেকে নির্বাচন কমিশনকে সরে আসার জোর দাবি জানাচ্ছি। একইসঙ্গে নির্বাচন কমিশনের উর্দ্ধতন দলবাজ কর্মকর্তাদের সরিয়ে কমিশন পুনর্গঠনের জোর দাবি করছি। দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নিঃশর্ত মুক্তি, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনই এখন জনগণের একমাত্র দাবি। এই দাবি এগিয়ে নিতেই বিএনপি অঙ্গীকারাবদ্ধ। ইভিএম ইস্যু তুলে জনদৃষ্টিকে বিভ্রান্ত করা যাবে না।
সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নুল আবদিন ফারুক,কবির মুরাদ,
প্রকাশনা সম্পাদক হাবিবুল ইসলাম হাবিব,সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুল আউয়াল সহ আরো অনেকে উপস্থিত ছিলেন।সূত্র-আরটিএনএন