গত সপ্তাহে অনুষ্ঠিত ইরাকের কুর্দিদের গণভোট প্যালেস্টাইন ও ইসরাইলিরা বিশেষ আগ্রহ নিয়ে পর্যবেক্ষণ করেছে। ইরাক থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার অভূতপূর্ব এই গণভোটে ইসরাইলি কর্মকর্তারা এবং অনেক সাধারণ ফিলিস্তিনি ভিন্ন কারণে অত্যন্ত খুশি।
বাগদাদের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া এবং ইরাক ও তুরস্কের তীব্র ক্ষোভ কুর্দি সংখ্যালঘুদের অস্থির করে তুলেছে। ফলে খুব সাহসাই উত্তর ইরাকে স্বাধীন কুর্দিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টি হচ্ছে না, তা অনেকটাই অনুমেয়।
কুর্দিদের জন্য প্যালেস্টাইনি সমর্থনের বিষয়টি বুঝতে পারা কঠিন কিছু নয়। এক শতাব্দী আগে যখন ব্রিটেন ও ফ্রান্স মধ্যপ্রাচ্যকে ভাগ করে কয়েকটি রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছিল, তখন ফিলিস্তিনিদেরকে উপেক্ষা করা হয়েছিল। কুর্দিদের মতো ফিলিস্তিনিরাও বিভিন্ন অঞ্চলে আটকে পড়েছে। দখলদার শক্তি কর্তৃক তারা নির্যাতিত।
কিন্তু কুর্দিদের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে ইসরাইলের জটিল স্বার্থকে বোঝা কঠিন।
কুর্দিদের স্বাধীনতার পক্ষে একমাত্র বিশ্ব নেতা ছিলেন ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু এবং অন্যান্য রাজনীতিবিদরা রাষ্ট্রের কাছে কুর্দিদের ‘নৈতিক অধিকার’ সম্পর্কে বক্তব্য রাখেন। ফিলিস্তিনি বিষয়ের সঙ্গে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি যে কতটা অস্বস্তিকর ছিল তা কেউ দেখেনি।
একটি অগভীর স্তরে ইসরাইল লাভবান হবে কারণ কুর্দিরা প্রচুর পরিমাণে তেলের ওপর ভাসছে। আরব রাষ্ট্র এবং ইরান বাদে কুর্দিরা এই তেল ইসরাইলের কাছে বিক্রি করতে আগ্রহী।
কিন্তু ইসরাইলি সমর্থনের কারণ অনেক গভীর। গত কয়েক দশক ধরে ইসরাইল ও কুর্দিদের মধ্যে সহযোগিতার কাজটি বেশিরভাগই গোপন ছিল।
ইসরাইলের বর্তমান অবসরপ্রাপ্ত জেনারেলরা ১৯৬০ এর দশকে কুর্দিদের প্রশিক্ষণ দিয়েছিল। এই সংযোগ ভুলে যাওয়ার নয় কিংবা শেষ হয়ে যায়নি। কুর্দিদের স্বাধীনতার র্যালি ও সমাবেশগুলোতে ইসরাইলি পতাকা বহন করা হয়েছে এবং কুর্দিরা এটিকে তাদের ‘দ্বিতীয় ইসরাইল’ বানানোর উচ্চাকাঙ্ক্ষার কথা বলছে।
আরব-আধিপত্যপূর্ণ অঞ্চলে ইসরাইল কুর্দিদের একটি গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী হিসেবে দেখে থাকে। এখন আইএসের প্রভাব কমে যাচ্ছে এবং একটি স্বাধীন কুর্দিস্তান ইরানকে অকার্যকর করতে পারে। ইরানের অস্ত্র বিনিময়, বুদ্ধিমত্তা এবং সিরিয়া ও লেবাননে তার শিয়া মিত্রদের বিরুদ্ধে ইসরাইল একটি নিরাপত্তা চায়।
তবে ইসরাইলের বর্তমান আগ্রহ একটি বৃহত্তর দৃষ্টিভঙ্গির ইঙ্গিত করে; যেটি এ অঞ্চলের জন্য দেশটি দীর্ঘ সময় ধরে লালন করে আসছে।
এটি শুরু হয়েছে ইসরাইলের প্রতিষ্ঠাতা ডেভিড বেন গুরিয়ন এর সময় থেকেই। তার পরিকল্পনা ছিল তুরস্ক, ইথিওপিয়া, ভারত এবং ইরানের মত নন-আরব দেশগুলোর সঙ্গে সামরিক সম্পর্ক স্থাপন। তারপর ইরানের শাহদের মতো শাসন করা। এর প্রধান লক্ষ্য ছিল ইসরাইলকে তার আঞ্চলিক বিচ্ছিন্নতা থেকে সাহায্য করা এবং মিশরীয় জামাল আবদেল নাসেরের নেতৃত্বাধীন আরব জাতীয়তাবাদ নিয়ন্ত্রণ করা।
১৯৮০’র দশকের শুরুতে ইসরাইলি জেনারেল এরিয়েল শ্যারন এই নিরাপত্তা মতবাদ প্রসারিত করেছিলেন। তিনি ইসরাইলকে মধ্যপ্রাচ্যে একটি সাম্রাজ্যবাদী শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠার দাবি তুলে। এই অঞ্চলে ইসরাইল একমাত্র পারমাণবিক শক্তিধর দেশ; যেটি দেশটিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে অপরিহার্য করে তোলে।
ইসরাইলের সাম্রাজ্যকে কিভাবে উপলব্ধি করা যায় সে সম্পর্কে শ্যারন সুস্পষ্ট ধারণা দেননি। তবে, একই সময়ে ইসরাইলি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা কর্তৃক ‘ইনিওন’ পরিকল্পনায় এর ইঙ্গিত দেয়া হয়েছিল।
এই পরিকল্পনায় মধ্যপ্রাচ্যকে বিভক্ত করার মাধ্যমে প্রভাব বিস্তারের প্রস্তাব করা হয়েছিল। বিশেষকরে ইসরাইলের প্রধান বিরোধীদের মাঝে সাম্প্রদায়িক ও জাতিগত বিদ্বেষ ছড়িয়ে দেয়ার মাধ্যমে এই উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের কথা বলা হয়েছিল।
তাদের লক্ষ্য ছিল মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে ফাটল সৃষ্টি করা এবং তাদের দুর্বল করা; যাতে ইসরাইল একমাত্র আঞ্চলিক শক্তি হিসাবে এই অঞ্চলে তার অবস্থানকে নিরাপদ করতে পারে।
এই ধারণার অনুপ্রেরণা দখলকৃত অঞ্চলগুলোতে রয়েছে। দখলকৃত এসব অঞ্চলে ইসরাইল পৃথক ছিটমহলের একটি সিরিজে ফিলিস্তিনিদের আবদ্ধ করেছে।
এছাড়াও, বর্তমান সময়ের মধ্যে ইসরাইল দ্বিধাহীনভাবে দক্ষিণ লেবাননে তার ধারণার পরীক্ষা চালায়। গত দুই দশক ধরে ইসরাইল এটি দখল করে রেখেছে। সেখানে ইসরাইলের উপস্থিতিতে খ্রিস্টান, দ্রুজ, সুন্নি এবং শিয়া মুসলমানদের মধ্যে জাতিগত উত্তেজনা চলছে।
এই অঞ্চলে ইসরাইলি-মার্কিন কর্তৃত্বের বিরোধিতাকারী দেশ ইরান, ইরাক ও সিরিয়াতে ইসরাইল ‘রুলিং ব্যাক’ আইডিয়া বাস্তবায়ন করতে চায়। ১৯৯১ সালে উপসাগরীয় যুদ্ধের সময় সাদ্দাম হোসেন ইসরাইলে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছিল। এজন্য দেশটি সাদ্দাম হোসেনকে ক্ষমতাচ্যুত করার বিষয়ে অগ্রাধিকার দিয়েছিল।
২০০৩ সালে ইরাক আক্রমণকে একটি দুর্ভাগ্যজনক পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হিসেবে বিবেচনা করা হলেও দেশটিতে সুন্নি, শিয়া ও কুর্দিদের রক্তাক্ত বিভেদকে ওয়াশিংটন সন্দেহজনকভাবে ইচ্ছাকৃত হিসেবে দেখে। এখন ইরাকি কুর্দিরা স্থায়ী বিচ্ছিন্নতার কাছাকাছি অবস্থান করছে।
গত মাসে ‘হার্জিলিয়া কনফারেন্সে’ ইসরাইলের নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক জাম্বোরিতে দেশটির বিচারপতি আয়েলেট শ্যাড কুর্দি রাষ্ট্রের প্রতি তার সমর্থন জানান। তিনি মন্তব্য করেন যে, এটি মধ্যপ্রাচ্যের ‘পুনর্নির্মাণে’ ইসরাইলি প্রচেষ্টার অবিচ্ছেদ্য অংশ।
সূত্র: মধ্যপ্রাচ্য ভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ‘দ্য নাশনাল’