স্পেনের সরকার দেশটির কাতালোনিয়া অঞ্চল এতদিন ধরে যে স্বায়ত্তশাসন ভোগ করছিল সেটি বাতিল করে পুরোটা কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এদিকে কাতালানের অধিবাসীরা তা প্রত্যাখান করেছে।
শনিবার স্বায়ত্তশাসন বাতিল করে স্পেন সরকার।
স্পেনের কাছ থেকে আলাদা হয়ে কাতালোনিয়ার নেতারা স্বাধীনতা ঘোষণা করার যে হুমকি দিয়েছিলেন, সে প্রেক্ষাপটে এখন স্বায়ত্তশাসন বাতিল করলো স্পেন। খবর বিবিসির।
স্পেনের এমন সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে কাতালানজুড়ে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। তারা যেকোনো মূল্যে স্পেন সরকারের এমন সিদ্ধান্ত প্রতিরোধ করার ঘোষণা দিয়েছে। রাজ্যটির মুখ্যমন্ত্রী কারলেস পুজেমন বলেছেন, সরকারের এমন সিদ্ধান্ত কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। যেকোনো মূল্যে প্রতিরোধ করবো আমরা।
স্পেনের প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর জানিয়েছে, দেশটির সংবিধানে ১৫৫ অনুচ্ছেদ কার্যকরের মাধ্যমে কাতালোনিয়ার স্বায়ত্তশাসন বাতিল করা হয়েছে, এখন সে অঞ্চলের কর্তৃত্ব নেয়া হবে।
অনেকে আশংকা করছেন স্পেন সরকারের এ সিদ্ধান্ত সে অঞ্চলকে অস্থির করে তুলতে পারে। স্পেনের প্রধানমন্ত্রী এক বিবৃতিতে বলেছেন, দেশটির সংবিধানে ১৫৫ অনুচ্ছেদে যা বলা আছে সে অনুযায়ী কাতালোনিয়ার নিজস্ব শাসন ব্যবস্থার উপর আইনগত কর্তৃত্ব ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা নেবে স্পেনের সরকার।
১৯৭৮ সালে প্রণীত স্পেনের সংবিধানে ১৫৫ ধারায় গণতান্ত্রিক শাসনের ভিত্তি তৈরি করা হয়েছে। সংবিধানের ১৫৫ ধারা অনুসারে স্পেনের সরকার যে কোনো সঙ্কটময় অবস্থার সময় কাতালোনিয়ার উপর সরাসরি শাসন জারির ব্যবস্থা রয়েছে।
কিন্তু অতীতে এটি কখনো প্রয়োগ করা হয়নি। স্পেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জনের জন্য গত ১ অক্টোবর কাতালোনিয়ায় গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। সে গণভোটে বেশিরভাগ কাতালোনিয়ার বেশিরভাগ মানুষ স্পেনের কাছ থেকে স্বাধীন হবার জন্য ‘হ্যাঁ’ ভোট দিয়েছে।
সে গণভোট নিয়ে স্পেন এবং কাতালোনিয়া অঞ্চলের নেতাদের মধ্যে তীব্র মতপার্থক্য এবং অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়।
এর আগে স্বাধীনতার ঘোষণা দিলে কাতালোনিয়া গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) বাজেট কমিশনার।
ব্যাপক পুলিশি সহিংসতায় গণভোট আয়োজনের পর স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে কাতালোনিয়া ও স্পেন সরকারের মধ্যে চলছে উত্তেজনা। এ সংকটের মুখে অনেক বড় বড় ব্যাংক কাতালোনিয়া থেকে তাদের সদর দফতর সরিয়ে নেওয়া ঘোষণা দিয়েছে। শুক্রবার ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য টেলিগ্রাফ এই খবর জানিয়েছে।
সোমবার কাতালোনিয়ার স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ার কথা জানিয়েছেন অঞ্চলটির নেতারা। আঞ্চলিক পার্লামেন্টে এই ঘোষণা দেয়ার কথা জানিয়েছিলেন কাতালানের এমপিরা। তবে বৃহস্পতিবার স্পেনের সাংবিধানিক আদালত কাতালোনিয়া পার্লামেন্টের অধিবেশন স্থগিত করলে পরিস্থিতি নতুন দিকে মোড় নেয়।
শুক্রবার কাতালোনিয়ার কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, আদালতের নিষেধাজ্ঞা অগ্রাহ্য করে সোমবার পার্লামেন্টের অধিবেশন বসবে এবং স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়া হবে।
এই পরিস্থিতিতে ইইউ বাজেট কমিশনার গানথার অতিঙ্গা স্পেনের বিবদমান দুই পক্ষকে সংলাপের আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘এই পরিস্থিতি খুবই কঠিন। ইউরোপই একটি গৃহযুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।’ তিনি মনে করেন একমাত্র ইউরোপীয় ইউনিয়নই এই সংকটে মধ্যস্ততা করতে পারে।
স্পেনের অন্যতম বৃহত্তম ব্যাংকিং গ্রুপ বাঙ্কো সাবাদেল ঘোষণা দিয়েছে তারা আলিকান্তেতে সদর দফতরে চলে যাচ্ছে। কাইজাব্যাংকেরও একই পরিকল্পনা।
স্প্যানিশ সংবাদমাধ্যম এল মুন্দোর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কাতালোনিয়াকে স্বাধীন রাষ্ট্র ঘোষণা করা হলে ব্যালেরিক দ্বীপে চলে যেতে পারে ব্যাংকটি।
বীমা কোম্পানি কাতালান অক্সিডেন্টও বলেছে যেকোনো কিছুর জন্য প্রস্তুত তারা। স্পেন সরকারও চাইছে কাতালোনিয়া থেকে বেরিয়ে আসুক প্রতিষ্ঠানগুলো। তাই তাদের প্রক্রিয়াও সহজ করার চেষ্টা করছে তারা। ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়, শুক্রবার এই বিষয়ে নির্দেশনা আসবে।
বুধবার স্প্যানিশ শেয়ারবাজারেও ধস নামে। ব্রেক্সিটের পর এটিই সর্বোচ্চ দরপতন। মাদ্রিদ সম্মেলনে যোগ দিতে আসা সংগঠনগুলোও শোনাচ্ছে অশনি সংকেত। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সংস্থাগুলোও কাতালোনিয়ায় ভোটারদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের পর বিনিয়োগে আগ্রহ হারাচ্ছে।
কাতালোনিয়া বংশদ্ভূত ব্রিটিশ ব্যবসায়ী জ্যাভিয়ের এডাম দ্য টেলিগ্রাফকে বলেছেন, তিনি এই পরিস্থিতিতে স্পেনে সবরকম বিনিয়োগের পরিকল্পনা বাতিল করেছেন।
লন্ডনে স্প্যানিশ দূতাবাসে পাঠানো এক চিঠিতে অ্যাডাম বলেন, তার এএমসি নেটওয়ার্ক কোম্পানি ৩০০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছেন। নেতিবাচক প্রচারণা, শুধু ভোট দিতে চাওয়া নিরপরাধ মানুষের উপর চড়াও হওয়ায় তারা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
স্পেনর অর্থমন্ত্রী লুইস দে গুইন্দোও কাতালোনিয়ায় আলাদা হওয়ায় ব্যাংকগুলো চলে যাবে ও অস্থিতিশীল অবস্থার তৈরি হবে বলে ইঙ্গিত দেন। ব্লুমবার্গ নিউজকে দেয়া সাক্ষাতকারে তিনি বলেন, ‘এ থেকেই বোঝা যায় কাতালোনিয়ার সরকার কতটা পাগল।’
অবশ্য কাতালান প্রেসিডেন্ট কার্লেস পুইগডেমন্ত বুধবার নিজ অবস্থা অটল থাকলে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত স্বাধীনতার ঘোষণা তারিখ সম্পর্কে নিশ্চিত করতে পারেননি।
স্প্যানিশ প্রধানমন্ত্রী মারিয়ানো রাজয়ের ভাষায় কাতালোনিয়ার সংলাপের আশা আরো কমে গেছে। তিনি জানান, তিনি আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবেন এবং কোনোরকম স্বাধীনতার ঘোষণা আসবে না।