মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যের সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর দেশটির নিরাপত্তা বাহিনী ও চরমপন্থী বৌদ্ধদের বীভৎস হত্যা আর ধ্বংসযজ্ঞে দেশটির নেত্রী নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী অং সান সু চি’র ভূমিকায় বিশ্বজুড়ে চলছে তীব্র সমালোচনা।
জাতিসংঘের মতে, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনী এবং সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর মধ্যে নতুন করে শুরু হওয়া এই সহিংসতায় প্রায় ৪ লাখ রোহিঙ্গা রাখাইন থেকে পালিয়ে প্রতিবেশি বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে।
দেশটির রাষ্ট্রীয় কাউন্সিলর ও কার্যত নেতা অং সান সু চি রাখাইনের বর্তমান পরিস্থিতিকে ‘ভুল তথ্যের বিশাল হিমশৈল’ বলে দাবি করেন।
রোহিঙ্গাদের বিশ্বের সবচেয়ে নিপীড়িত সংখ্যালঘু হিসাবে চিহিৃত করা হয়ে থাকে। তাদের বেশিরভাগই মুসলিম জাতিগোষ্ঠীর। শত শত বছর ধরে তারা বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ট মায়ানমারে বাস করলেও দেশটির তাদের নাগরিকত্বকে অস্বীকার করছে।
মায়ানমারের গণতন্ত্রকে সমর্থন করার জন্য ১৯৯১ সালে অং সান সু চিকে নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রদান করা হয়। চলমান রোহিঙ্গা সঙ্কটে সু চি’র ভূমিকা নিয়ে ইতোমধ্য বেশ কয়েকজন হাই প্রোফাইল ব্যক্তি তার তীব্র সমালোচনা করেছেন।
তবে, অং সান সু চিকে নিন্দা করতে বিশ্বের সব নেতা একতাবদ্ধ নয়।
উদাহরণস্বরূপ, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তার বক্তব্যে রোহিঙ্গাদের বিষয় কথা বলতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন এবং এর পরিবর্তে তিনি সু চিকে তার সমর্থনের প্রস্তাব দিয়েছেন।
৬ সেপ্টেম্বর মায়ানমারের রাজধানী নাইপেদো সফরকালে তিনি বলেন, ‘রাখাইন রাজ্যে চরমপন্থী সহিংসতা, বিশেষ করে নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে সহিংসতার বিষয়ে আপনার সঙ্গে আমরাও উদ্বেগ প্রকাশ করছি।’
অং সান সু চি’র নোবেল প্রত্যাহার চেয়ে প্রায় চার লাখ মানুষ অনলাইনে একটি পিটিশনে স্বাক্ষর করেছে। সু চি তার দেশে মানবতার বিরুদ্ধে এই অপরাধকে থামানোর জন্য প্রকৃতপক্ষে কিছুই করছেন না বলে তাদের অভিযোগ।
চেইঞ্জ ডট ওআরজি’র চালু করা ওই পিটিশনে বলা হয়, ‘এই পুরস্কার কেবল তাদের দেয়া হয়েছে, যারা তাদের আন্তর্জাতিক ভ্রাতৃত্বকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছিল। সু চি’সহ নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ীদের এই শান্তিপূর্ণ মূল্যবোধকে আমৃত্যু লালন করা উচিৎ।’
এতে আরো বলা হয়, ‘যখন শান্তিতে নোবেল বিজয়ী একজন ব্যক্তি শান্তি বজায় রাখতে পারে না, তখন শান্তির জন্যই নিজ উদ্যোগে পুরস্কারটি ফেরত দেওয়া নৈতিক দায়িত্ব কিংবা নোবেল শান্তি পুরস্কার কমিটি কর্তৃক সেটি জব্দ করা উচিৎ।’
মালালা ইউসুফজাই
মায়ানমারের চলমান সঙ্কটে সু চি’র নিষ্ক্রিয় অবস্থানের তীব্র নিন্দা করেছেন সর্বকনিষ্ঠ নোবেল শান্তি বিজয়ী মালালা ইউসুফজাই।
তিনি মায়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে রক্ষায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের হস্তক্ষেপ কামনা করেন। একইসঙ্গে তিনি রোহিঙ্গাদের পক্ষে মুখ খোলার জন্য মায়ানমারের নেত্রী অং সান সু চির প্রতি আহ্বান জানান।
সবকনিষ্ঠ এই নোবলে বিজয়ী বলেন, ‘মায়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমানদের দুর্দশা দেখে আমার হৃদয় ভেঙ্গে যায়। হাজার হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হচ্ছে, এ অবস্থায় আমরা চুপ থাকতে পারি না।’
তিনি আরো বলেন, ‘এটি মানবাধিকার ইস্যু। সরকারের উচিত প্রতিক্রিয়া দেখানো। জনগণ ঘরহারা হচ্ছে। সহিংসতার মুখোমুখি হচ্ছে। শিশুরা শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, বঞ্চিত হচ্ছে সব ধরনের মৌলিক অধিকার থেকে। সহিংস অবস্থার মধ্যে তাদের বাস করতে হচ্ছে। এমন সহিংস অবস্থার মধ্যে বাস করাটা খুবই কঠিন। আমাদের উচিত এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া এবং আমি আশা করব, অং সান সু চিও সাড়া দেবেন।’
৩ সেপ্টেম্বর এ নিয়ে এক টুইটে মালালা বলেন, ‘মুসলমানদের ওপর ওই অমানবিকতা হৃদয়বিদারক। মায়ানমারের শিশুদের ছবি আমি দেখেছি। এর চেয়ে কষ্টের আর কিছু হয় না।’
মালালা বলেন, ‘আমার নিজের দেশ পাসিস্তানসহ অন্যান্য দেশগুলোর উচিৎ বাংলাদেশকে উদাহরণ হিসেবে অনুসরণ করা এবং সহিংসতা থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা পরিবারকে খাদ্য, আশ্রয় ও শিক্ষা প্রদান করা।’
আর্চবিশপ ডেসমন্ড টুটু
রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর সরকারের আচরণ নিয়ে নীরব ভূমিকায় থাকা দেশটির সরকারপ্রধান ও শান্তিতে নোবেল জয়ী অং সাং সু চির সমালোচনা করেছেন আরেক নোবেল জয়ী ডেসমন্ড টুটু। সরকারের আচরণে সৃষ্ট রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে হস্তক্ষেপ করতে সুচিকে এগিয়ে আসার আহ্বানও জানান দক্ষিণ আফ্রিকার এই এমিরেটাস ধর্মযাজক।
৭ সেপ্টেম্বর প্রিটোরিয়ায় নিযুক্ত মায়ানমার দূতাবাসের মাধ্যমে সূচিকে দেয়া এক খোলা চিঠির মাধ্যমে এই আহ্বান জানান তিনি। চিঠিতে তিনি সু চিকে অত্যন্ত প্রিয় বোন হিসেবে উল্লেখ করেন। বলেন, ‘আমার ডেস্কে তোমার একটি ছবি থাকত আর সেই ছবির দিকে তাকিয়ে সব সময় গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের কথাই ভাবতাম সব সময়।’
রোহিংঙ্গা ইস্যুতে তিনি বলেন, ‘নীরবতাই যদি মায়ানমারের সর্বোচ্চ ক্ষমতায় যাওয়ার রাজনৈতিক মূল্য হয় তাহলে এই মূল্য সত্যিই খুব চড়া।’
তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের দুঃখ-কষ্ট সবার মনে যন্ত্রণা আর ভয় ধরিয়ে দিয়েছে। মানবতা যেখানে লঙ্ঘিত হচ্ছে এই রকম একটা দেশের নেতৃত্বে ন্যায়পরায়ণতার প্রতীক একজন ব্যক্তির থাকা এখন খুবই বেমানান।’
দক্ষিণ আফ্রিকার এই কিংবদন্তি বলেন, ‘এ সব ভয়ংকর চিত্র আসার সঙ্গে সঙ্গে আপনার জন্যও প্রার্থনা করছি, আপনি আবার ন্যায়বিচার, মানবাধিকার ও মানুষের মত্যৈক্য তৈরিতে কাজ করুন, হয়ে উঠুন স্পষ্টভাষী।’
শিরিন ইবাদি
বিখ্যাত মানবাধিকার কর্মী এবং ২০০৩ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী শিরিন ইবাদী। মায়ানমারের ক্ষমতায় আসার পর গণতন্ত্র থেকে সরে আসার জন্য তিনি অং সান সু চিকে অভিযুক্ত করেন।
ইবাদি বলেন, ‘অং সান সুচি এই পুরস্কারের আদর্শ তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছেন।’
সম্প্রতি ডয়চে ভেলেকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে সু চির কঠোর সমালোচনা করে ইবাদি বলেন, ‘রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানের বিষয়টিকে অবহেলা করছেন সু চি। তারপরও আমি বলবো, নোবেল পুরস্কার পাওয়ার জন্য তিনি যোগ্য ব্যক্তি ছিলেন।’
অ্যান্টোনিও গুতেরেস
মায়ানমারের চলমান সঙ্কটের দ্রুত অবসানের জন্য দেশটির কর্মকর্তাদের কাছে আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্টেনিও গুতেরেস।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে নিজের উদ্বেগ প্রকাশ করে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে পাঠানো একটি চিঠিতে গুতেরেস বলেন, অব্যাহত সহিংসতা মানবিক বিপর্যয় ঘটাতে পারে।
যদিও তিনি সরাসরি অং সান সু চির সমালোচনা করেননি। তবে তিনি মায়ানমারের নেতাদের নিন্দা করেছেন।
৫ সেপ্টেম্বর সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘এই সহিংসতার অবসান ঘটানোর জন্য বেসামরিক এবং সামরিক কর্তৃপক্ষসহ মায়ানমারের সকল কর্তৃপক্ষের কাছে আমি আবেদন করছি। আমার মতে, সেখানে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে যা এই অঞ্চলের অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে পারে।’
তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের দুঃখকষ্ট এবং অমীমাংসিত দুর্দশা দীর্ঘ সময় ধরে বিদ্যমান রয়েছে।’
রিসেপ তাইয়্যেপ
মায়ানমারের রোহিঙ্গাদের সাহায্য করার জন্য তিনি বিশ্ব নেতৃবৃন্দকে অনুরোধ জানানোর পাশাপাশি তিনি এই হত্যাযজ্ঞকে ‘গণহত্যা’ বলে অভিহিত করেন।
চলতি মাসে নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের বৈঠকে বিষয়টি উত্থাপন করবেন বলে এরদোগান ঘোষণা দেন।
গত ৪ সেপ্টেম্বর এরদোগান বলেন, ‘আপনারা মায়ানমার ও মুসলমানদের পরিস্থিতি দেখেছেন … আপনারা দেখেছেন কিভাবে রোহিঙ্গা গ্রামগুলো পুড়ে গেছে … মায়ানমারের গণহত্যায় মানবতা আজ নীরব রয়ে গেছে।’
যদিও এরদোগান অং সান সু চি’র সরাসরি সমালোচনা করা থেকে বিরত থাকেন। তবে, ৫ সেপ্টেম্বর সু চিকে এক টেলিফোন কলে বলেন, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে চলমান সহিংসতায় মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে।
টেলিফোনে আলোচনার সময় তিনি স্পষ্ট করে বলেন যে, রোহিঙ্গাদের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে মুসলিম বিশ্ব গভীরভাবে উদ্বিগ্ন।
উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় রাখাইনে তুর্কি সহায়তা প্রবেশ করতে দিতে তিনি মায়ানমারকে রাজী করান। ৬ সেপ্টেম্বর রাখাইন রাজ্যে আনুমানিক ১,০০০ টন খাদ্য, বস্ত্র ও ঔষধ বিতরণ করা হয়।
পিটার পপহ্যাম
পিটার পপহ্যাম, যিনি সু চির জীবন ও কর্ম সম্পর্কে দুইটি লেখেছেন। তিনি সহিংসহা বন্ধের জন্য অং সান সু চিকে আহ্বান জানান।
তিনি বলেন, ‘সামরিক বাহিনীকে চ্যালেঞ্জ করার পরিবর্তে, সু চি এখন তাদের সহায়তা করছেন। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে অপারেশনে তিনি সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাইংয়ের একজন সহযোগী।’
তিনি বলেন, ‘বার্মার দ্য ফ্যাক্টো সরকারের শাসক হিসাবে এই ভয়ানক প্রতিক্রিয়ার চূড়ান্ত দায়িত্ব সু চি’র ওপরও বর্তাবে। বিশ্বের একজন মর্যাদাপূর্ণ ও বিখ্যাত বার্মিজ ব্যক্তি হিসেবে তিনি বিশ্বের কাছে এই সহিংসতার একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন কিন্তু তার প্রতিক্রিয়া সত্যিই লজ্জাজনক। তিনি বাইরের বিশ্বের আবেগকে বুঝতে পারেন না বলেই মনে হয়।’
বরিস জনসন
মায়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর চালানো দমন-পীড়নে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বরিস জনসন। এই সহিংসতা ‘বার্মার খ্যাতিকে কলঙ্কিত করেছে’ বলে মন্তব্য করেন।
২ সেপ্টেম্বর এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘এই সঙ্কট সমাধানে সু চি তার ‘অসাধারণ গুণ’ ব্যবহার করবে বলে যুক্তরাজ্যে আশা করে।’
তিরানা হাসান
সু চির ভূমিকার সমালোচনা করে অ্যামনেস্টির ক্রাইসিস রেসপন্স ডিরেক্টর তিরানা হাসান বলেন, রোহিঙ্গাদের দেশ থেকে তাড়াতেই মায়ানমারের সেনাবাহিনী রাখাইনে অভিযান চালাচ্ছে। নিঃসন্দেহে এটি জাতিগত নির্মূল অভিযান।
সূত্র: আলজাজিরা