আন্তর্জাতিক ডেস্ক:
ছোট্ট শান্তিপ্রিয় বন্ধু দেশ ভুটানে দাদাগিরির মাসুল গুনছে দিল্লি। দেশটির অনুরোধে আপাতত চোখে সর্ষে ফুল দেখছে নরেন্দ্র মোদীর সরকার।
ভুটানের ডোকলাম উপত্যকাকে কেন্দ্র করে চীন-ভারত স্নায়ুযুদ্ধ এখন তুঙ্গে। দু’দেশই বাড়তি সেনা মোতায়েন করেছে ওই এলাকায়। ভুটান ওই বাড়তি আড়াই হাজার সেনা প্রত্যাহার করে নেয়ার জন্য কূটনৈতিক চ্যানেলে অনুরোধ জানিয়েছে ভারতকে। চীনকেও একই অনুরোধ করেছে তারা।
চীনের সঙ্গে দ্বন্দ্বের এই আবহে ভুটান যে এভাবে বেঁকে বসতে পারে, তা ভাবতেও পারেননি ভারতের কূটনীতিকেরা।
হিমালয়ের কোলের এই একমুঠো রাষ্ট্রকে নিজেদের তাঁবেদারীতে থাকা দেশ বলেই মনে করে দিল্লি।
১৯৪৯ সালে ভুটানের সঙ্গে শান্তিচুক্তি করেছিলেন জওহরলাল নেহরু। সেই চুক্তিতে বলা হয়েছিল, বিদেশ নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে ভুটান ভারতের পরামর্শ মতোই চলবে। ২০০৭ সালে ভুটান যখন পুরোদস্তুর রাজতন্ত্র থেকে সংসদীয় গণতন্ত্রের পথে হাঁটে, তখন চুক্তিপত্র থেকে এই ধারাটি বাদ দেয়া হয়। যদিও কার্যক্ষেত্রে থিম্পুর উপরে দিল্লির প্রভাব খুব একটা খর্ব হয়নি। ডোকলাম নিয়ে ভারতের চাপের মুখে চীনকে ডিমার্শেও পাঠিয়েছে ভুটান। তার পরেও তার এই বেসুর সাউথ ব্লকের কানে বাজছে।
কূটনীতিকদের অনেকের মতে, প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সার্বিক ভাবেই ভারতের সম্পর্কের অবনতি হয়েছে। ভারতের দাদাগিরির কারণে নেপাল, শ্রীলঙ্কা এমনকী বাংলাদেশের সঙ্গেও নানা বিষয়ে জটিলতা বাড়ছে। সেই সুযোগটা নিচ্ছে চীন। তারা নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মায়ানমার, বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতি ঘটিয়েছে। সেই সব দেশের সীমান্ত এলাকায় পরিকাঠামো নির্মাণের কাজও করছে বেইজিং। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফরের পরে বাংলাদেশে চীনা লগ্নি বাড়ার সম্ভাবনা তৈরি হওয়ায় উদ্বিগ্ন দিল্লি।
চীন ডোকলাম নিয়ে ভারতকে জানিয়েছে, এটা তাদের সঙ্গে ভুটানের দ্বিপাক্ষিক বিষয়। দিল্লির সঙ্গে তারা কথা বলবে কেন? ভারত ওই এলাকা থেকে সেনা না সরালে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে না বলেও জানিয়ে দিয়েছে তারা।
এই অবস্থায় ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র শনিবার বলেছে, ভুটান থেকে ভারতীয় সেনা প্রত্যাহার করা হবে না বলে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে যে খবর প্রকাশিত হয়েছে, তা ঠিক নয়। ফলে কূটনৈতিক মহলে জল্পনা, তবে কি কিছু সেনা সরানোর কথা ভাবা হচ্ছে?
পাশাপাশি, মোদী সরকার এখন বুঝতে পারছে যে, চীনকে এতটা খুঁচিয়ে ঘা করাটা ঠিক হয়নি। সেই কারণেই সর্বদলীয় বৈঠক এবং বরফ গলানোর চেষ্টা। কিন্তু চীনের এতটা রেগে যাওয়ার কারণ কী? ভারত দীর্ঘদিন আগে থেকেই তিব্বতকে চীনের অঙ্গ হিসেবে মেনে নিলেও গত লোকসভা ভোটের আগে অরুণাচল প্রদেশে গিয়ে ফের সেই বিতর্ক উস্কে দেন মোদী। ভোটের পর চীনের আপত্তি সত্ত্বেও দলাই লামা অরুণাচল যান এবং সে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বিবৃতি দিয়ে বলেন, ‘আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র তিব্বত’ (অর্থাৎ চীন নয়)। এর পাশাপাশি, পাক শাসিত কাশ্মীরের গিলগিট দিয়ে বেলুচিস্তানের গ্বদর বন্দর পর্যন্ত অর্থনৈতিক করিডর গঠনে ভারতের বাধা দেয়া এবং বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে ভারত যোগ না দেয়ায় চীন ক্ষুব্ধ।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র অবশ্য বলছে, মোদী চীন সম্পর্কে ভারতের নীতির পুনর্গঠন করছেন। তাদের দাবি, রাজীব গান্ধী থেকে মনমোহন সিংহ, সকলেই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের দাদাগিরি সহ্য করে এসেছেন। কিন্তু এই প্রথম চীনকে অস্বস্তিতে ফেলেছে মোদীর কৌশল।
যদিও অধিকাংশ কূটনীতিকই মনে করেন, সামরিক দিক থেকে চীন এখনো ভারতের চেয়ে শক্তিশালী। তাই কাশ্মীর নিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে চলতি সংঘাতের আবহে চীনের সঙ্গে ৫৬ ইঞ্চি ছাতি প্রদর্শন উচিত কাজ হয়নি।
ভারতীয় কূটনীতিকদের আশঙ্কা, ভুটানের বিতর্কিত ভূখণ্ড নিয়ে চীন যদি জাতিসংঘে যায়, সে ক্ষেত্রে নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য রাশিয়া কতটা ভারতের পাশে থাকবে? দ্বিতীয়ত, শিলিগুড়ির কাছে ‘চিকেন নেক’ অবরুদ্ধ হলে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে ভারতের মূল ভূখণ্ডের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। কারণ, বাংলাদেশের স্থলপথ দিয়ে উত্তর-পূর্বাঞ্চলে যাওয়ার সড়কপথ নির্মাণের কাজে ভারত এখনো সফল হতে পারেনি। তৃতীয়ত, ইজরাইল ভারতের পাশে থাকবে বলে আশা করা হলেও ইজরাইলের প্রধানমন্ত্রী কিন্তু সম্প্রতি চীন সফরে গিয়ে বন্ধুত্বের অঙ্গীকার করে এসেছেন। চতুর্থত, পাকিস্তানের সঙ্গে সুসম্পর্কের জেরে পাক শাসিত কাশ্মীরে যদি চীন সেনা মোতায়েন করে, তা হলে কী হবে?
এই অবস্থায় চীনের কড়া মনোভাব দেখে মোদী সরকার এখন সর্বদল বৈঠক করে চীনকে নরম করিয়ে আলোচনার পথে আনতে চাইছে।
আন্দবাজার অবলম্বনে