
সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম গুলো আমাদের সমাজে ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। বর্তমানে তা আমাদের জীবনের অপরিহার্য অংশে পরিণত হয়েছে। ফলে দিনে দিনে আমরা এসব যোগাযোগের মাধ্যম গুলোর মাঝে ডুবে গিয়ে বাস্তবের চারপাশকে সত্যিকার অর্থে দূরে ঠেলে দিচ্ছি। ফলে স্বামী-স্ত্রী, মা-বাবা, ভাই-বোনের মতো সম্পর্কের বাস্তব অনুভূতিগুলো আজ দিনে দিনে বোধহীন, ফ্যাকাশে হয়ে উঠছে। যা দৈনন্দিন জীবনের স্বাভাবিক সুস্থ, সুন্দর ও মধুর সম্পর্কের ক্ষেত্রগুলোকে মনের অজান্তেই নষ্ট করে দিচ্ছে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ফেসবুক। ২০০৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজ কক্ষে মার্ক জুকারবার্গ যে ফেসবুক নামক যোগাযোগ মাধ্যমটি নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডিতে চালু করেছিলেন, তা সেই কবেই জনপ্রিয়তার মাধ্যমে ক্রমশ তার গন্ডিছাড়িয়ে আজ যোগাযোগের সবচেয়ে শক্তিশালী অন্যতম মাধ্যম হিসেবে পরিচিত সারা বিশ্বব্যাপী।
এক সমীক্ষা দেখা গেছে, ২০১১ সালের মে মাস নাগাদ বিশ্বে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল প্রায় ৭০ কোটি। আর ২০১৬ সালে এসে সেই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৬৫ কোটি ৪০ লক্ষে। ফেসবুকের দেয়া তথ্যমতে, প্রতিদিন এই চ্যানেলের গ্রাহক তালিকায় প্রায় ২ লক্ষ নতুন নাম যুক্ত হচ্ছে। আর এই জনপ্রিয়তাকে অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই।
বিশ্বব্যাপি সামাজিক যোগাযোগের এই উত্থান সম্পর্কে স্প্যানিশ বংশোদ্ভূত সমাজবিজ্ঞানী ও ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়ার অধ্যাপক ম্যানুয়ের ক্যাসলস ২০০০ থেকে ২০০৯-১০ বছর গবেষণা করে ইনফরমেশন এজ (তথ্য যুগ) নামে তিন খণ্ডের বই লিখেছেন। এ গুলো হল: দি রাইজ অব নেটওয়ার্ক সোসাইটি, দি ইনফরমেশন এজ: ইকোনমি, সোসাইটি অ্যান্ড কালচার (প্রকাশক: উইলি অ্যান্ড ব্ল্যাকওয়েল, ইংল্যান্ড)।
ম্যানুয়েলের গবেষণার সূত্র ধরে এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এ আই মাহবুব উদ্দিন আহমেদ বলেছেন, ম্যানুয়েল তার গবেষণায় দেখাতে চেয়েছেন, নেটওয়ার্কের কারণে আমরা একটা ভার্চুয়াল জগতে বাস করছি। ধীরে ধীরে যা হচ্ছে, তা হলো নেট বনাম ব্যক্তিজীবন। দিন দিন মানুষ সমাজে একা হয়ে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, ম্যানুয়াল তার বইগুলোতে এই ব্যাপারটাও বলেছেন—‘পারিবারিক বন্ধনটা ধীরে ধীরে ফেসবুকে স্থানান্তরিত হচ্ছে। আগে পরিবারের সবাই একসঙ্গে খেত। বাসায় একটা টেলিফোন থাকত। এখন প্রত্যেকের আলাদা আলাদা ফোন। বাসায় ফিরে যে যার ঘরে ফোন বা নেট নিয়ে ব্যস্ত। নেটে যে তথ্য আমরা পাচ্ছি, তা প্রসেস করতে গিয়ে সময় ব্যয় হচ্ছে। ফলে বাস্তবজীবনের সামাজিকতা দিন দিন কমে যাচ্ছে।
আজকাল রাত জাগা একটা সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে উল্লেখ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক বলেন, রাত জেগে ফোনে কথা বলছে বা নেট ব্যবহার করছে। এখনকার বেশির ভাগ যুবকই ভোরের আকাশ দেখে না। বেলা করে যখন ঘুম থেকে উঠছে, তখন পরিবারের অন্যরা যে যার কাজে বের হয়ে গেছে। আসলে এই ভার্চুয়াল যোগাযোগ আপনাকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলছে সমাজ থেকে। সামাজিক যোগাযোগের কারণে একাধিক সম্পর্ক হয়ে যাচ্ছে একই সময়ে। এ কারণে অনেক সম্পর্কেই গভীরতা তৈরি হচ্ছে না।
ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ল্যারি রোজেন এক গবেষণায় দেখিয়েছেন মাত্রাতিরিক্ত পরিমাণ ফেসবুকের ব্যবহার মানুষের মধ্যে আত্মপূজার মনোভাব সৃষ্টি করছে। যার ফলে সমাজে বেড়েছে অসামাজিক আচরণ, তীব্র টেনশন বা উত্তেজনা। কিশোর-কিশোরীদের সহিংস আচরণ ইত্যাদি বেড়েই চলছে। আমরা যত যান্ত্রিক জীবনযাপন করছি ততই আমাদের প্রিয় বন্ধনগুলো আস্তে আস্তে গৌণ হয়ে উঠেছে।
অনেকেই বেশিরভাগ সময় থাকেন যন্ত্রের সঙ্গে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপ্রয়োজনীয় টুইটারিং, ফেসবুকিং বা উদ্দেশ্যবিহীন নেট সার্ফিংয়ে নিজেকে ব্যাস্ত রাখেন। অনেকে শিক্ষামূলক সাইটের চেয়ে পর্নো সাইটগুলোতে অযথা সময় নষ্ট করেন। এতে অনেকের চরিত্র যেমন নষ্ট হচ্ছে তেমনি নৈতিকতা তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। অনেকে আবার সামাজিক সাইটে অসামাজিক সম্পর্ক গড়ে তুলে স্বর্গীয় সংসারকে নরকে পরিণত করছে।
কম্পিউটার ইন হিউম্যান বিহেভিয়ার সাময়িকীর জুলাই ২০১৪ সংখ্যায় এক গবেষণা-প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ‘ফেসবুক, টুইটার বা এ রকম মাধ্যমগুলোতে বেশি সময় দেওয়া মানুষেরা দাম্পত্যজীবনে অসুখী হতে পারেন, এমনকি বিয়েবিচ্ছেদের কথাও ভাবতে পারেন। এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সুলতানা আলগীন বলেছেন, কতগুলো বিষয় ইতিবাচক।
তিনি বলেন, ফেসবুকে পুরোনো বন্ধুদের খুঁজে পাচ্ছি, নিজের কথা নিজের কোনো মুহুর্ত ভাগাভাগি করতে পারছি। এর কিছু নেতিবাচক দিকও রয়েছে ফেসবুকের মাধ্যমে সামাজিকতা, সৌজন্যবোধকে আমরা দিন দিন হারাচ্ছি। এখন আমাদেরই কোনো কোনো বন্ধু আছে যাদের সঙ্গে সামনাসামনি কথা বলার আগে বলে নিতে হয় তোমার মোবাইল ফোন আগে বন্ধ করো, তারপর কথা।