‘অন্ধাকানুন’। ভারতীয় বিচারব্যবস্থাকে বহূবছর ধরেই এই নামে ডাকেন ভারতের আমজনতা। বিভিন্ন ভারতীয় আদালতে বছরের পর ধরে পরে আছে লক্ষ লক্ষ মামলা। জীবন শেষ হয়ে যায়, মামলা শেষ হয় না। ক্ষমতা ও টাকার দাপটে অন্যায়কারীর সাজা হয় না। বিনা অপরাধে জেলের ঘানি টানতে হয় ক্ষমতাহীন মানুষকে। অন্ধ আইনের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকেই দিলেন রাজস্থান হাইকোর্টের বিচারপতি মহেশচন্দ্র শর্মা। কর্মজীবনের শেষ দিনে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন হাস্যকর ভারতীয় বিচারব্যবস্থার হাল।
গবাদি পশু নির্যাতন রুখতে কেন্দ্র যে নতুন বিধির কথা বলেছে, মাদ্রাজ হাইকোর্ট মঙ্গলবারই তার বিরুদ্ধে স্থগিতাদেশ দিয়েছে। এদিকে বুধবার রাজস্থান আদালত অন্য একটি মামলার রায় দিতে গিয়ে, কেন্দ্রের সেই নতুন বিধির উপর শিলমোহর তো দিলেনই, ঘোষণা করে দিলেন অবিলম্বে গো-হত্যা নিষিদ্ধ করে গরুকে জাতীয় পশুর মর্যাদা দিতে হবে। একুশে আইনের এই ‘বালখিল্যের’ মতো আচরণ, মানুষকে বিচারব্যবস্থার প্রতি আরো নিরুৎসাহ করে তুলবে, সেকথা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
কিভাবে ভারতীয় আইন ব্যবস্থাকে গোটা দেশের কাছে হাস্যকর করে তুললেন রাজস্থান হাইকোর্টের বিচারপতি মহেশচন্দ্র শর্মা? জয়পুরে সরকারি গোশালায় গরুদের অবস্থার অবনতি নিয়ে একটি মামলা হয়েছিল রাজস্থান হাইকোর্টে। বিচারপতি শর্মা সেই মামলাতেই রায় শোনাতে গিয়ে নিজেকে বিচারপতির আসন থেকে নামিয়ে একেবারে একটি রাজনৈতিক দলের কর্মীর মতো আচরণ করলেন। তার মন্তব্যে পরিস্কার হয়ে গেল ভারতীয় বিচারব্যবস্থায় আইনের চেয়েও বিচারপতিদের নিজস্ব মতবাদ কতটা প্রভাব ফেলেছে।
নিজের রায়ে বিচারপতি মহেশচন্দ্র শর্মা জানিয়ে দেন, নেপালের মতোই ভারত সরকারের উচিত গরুকে ভারতের জাতীয় পশু ঘোষণা করা। আদালতের বাইরে সাংবাদিকদের তিনি জানান, গো-হত্যার চেয়ে বড় অপরাধ আর হতে পারে না, আইনে গো-হত্যার কঠোর সাজার ব্যবস্থা করা উচিত।
এরপর ভারতের জাতীয় পাখী ময়ূর নিয়ে বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ময়ূর আজীবন ব্রহ্মচারী থাকে, চোখের জলেই ময়ূরের সঙ্গে ময়ূরীর মিলন হয়, তারপর বাচ্চা হয়।
কলকাতা ও রাজ্য জুড়ে এখন ভুয়া চিকিৎসক খুঁজে বেরাচ্ছে পুলিশ। একের পর এক ভুয়া চিকিৎসক ধরা পরছে সিআইডির জালে। বিচারপতি মহেশচন্দ্র শর্মা ময়ূর ময়ূরীর মিলন নিয়ে যা বলেছেন তাতে আবার ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের পুলিশকে ভুয়া বিচারপতি খুঁজতে বেরোতে না হয়! আপাতত বিভিন্ন মিডিয়ায় হাসির খোরাক ভারতীয় বিচারব্যবস্থা।
কিছুদিন আগেই বিচার ব্যবস্থায় অনন্য নজির গড়েছিলেন কলকাতা হাইকোর্টের বিচারতি সি এস কারনান। প্রধান বিচারপতিসহ সুপ্রিম কোর্টের আট বিচারপতির কারাদণ্ডের নির্দেশ দিয়েছিলেন বিচারপতি কারনান। তখনো উঠে এসেছিলো বিচারপতিদের মুল্যবোধের প্রশ্ন। বিচার বিভাগের দূর্নীতি নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের একাধিক দফতরে চিঠি লিখেছিলেন বিচারপতি কারনান। সেই সব অভিযোগ নিয়েই স্বতঃপ্রণোদিতভাবে আদালত অবমাননার মামলা দায়ের করে তাকে তলব করেছিল সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চ। কিন্তু আত্মসমপর্ণ না করায় তার বিরুদ্ধে জারি করা হয় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা।
এরপরই সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি জে এস খেহারসহ অন্য সাত বিচারপতির পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডের নির্দেশ দেন বিচারপতি কারনান। আবার সেই নির্দেশ খারিজ করে বিচারপতি কারনানকে বিচার বিভাগীয় হেফাজতে নেয়ার নির্দেশ দেয় সুপ্রিম কোর্ট। হাস্যকর হয়ে যায় ভারতীয় বিচারব্যবস্থা।
এর আগে কলকাতা হাইকোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি সৌমিত্র সেন বছরের পর বছর ধরে সরকারের ৩৭ লক্ষ টাকা নিজের কাছেই রেখে দিয়েছিলেন যা কোনো দিন জানাই যেত না, যদি না এসএআইএল মামলা করত। সে বার গুরুতর অপরাধ করেও ইম্পিচমেন্ট এড়ানোর জন্য চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে পালিয়ে বেঁচেছিলেন এই সাবেক বিচারপতি। ভারতীয় বিচারব্যবস্থার বেহাল দশা সেদিনও মানুষের সামনে উঠে এসেছিলো। তখনো বিচারব্যবস্থার ঘূণ ধরা ছবিটা পরিস্কার হয়ে যায় মানুষের কাছে।
ভারতের বিভিন্ন আদালতে বিভিন্ন সময়ে একই বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন রায়, কখনো বিচারপতিদের অদ্ভুত রায় সাধারণ মানুষকে বিচার ব্যবস্থার প্রতি আরো নিরূৎসাহ করে তুলেছে তা বলাই যায়।
আর, গত কয়েক বছরের মধ্যে কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি সৌমিত্র সেন ও বিচারপতি কারনান ইস্যুতে বেআব্রু হয়ে গিয়েছিল ভারতের বিচারব্যবস্থা। আর বিচারব্যবস্থার সেই কফিনেই শেষ পেরেক ঠুকে দিলেন রাজস্থান হাইকোর্টের বিচারপতি মহেশচন্দ্র শর্মা। সার্থক হল ‘অন্ধাকানুন’ নাম।
সূত্র: কলকাতা২৪