
দেশে শিল্প বিকাশ ও বেসরকারী বিনিয়োগ বাড়াতে ১৪টি বেসরকারী অর্থনৈতিক অঞ্চলের লাইসেন্স প্রদান করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা।
তিনি জানান, এরমধ্যে ৪টিকে চূড়ান্ত ও ১০টিকে প্রি-কোয়ালিফিকেশন লাইসেন্স দেয়া হয়েছে।
বুধবার জাতীয় সংসদ অধিবেশনে প্রশ্নোত্তর পর্বে তিনি এ তথ্য জানান।
স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে শুরু হওয়া অধিবেশনে এসংক্রান্ত প্রশ্নটি উত্থাপন করেন সরকার দলীয় সংসদ সদস্য দিদারুল আলম।
প্রধানমন্ত্রীর দেয়া তথ্যানুযায়ী চূড়ান্ত লাইসেন্স পাওয়া বেসরকারী অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো হলো- নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও-এ মেঘনা ইকোনমিক জোন, মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ায় আবদুল মোনেম অর্থনৈতিক অঞ্চল, নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও-এ আমান ইকোনমিক জোন ও গাজীপুরের কোনাবাড়ী বেসরকারী অর্থনৈতিক অঞ্চল।
প্রি-কোয়ালিফিকেশন লাইসেন্স পাওয়া অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো হলো- ঢাকার কেরানীগঞ্জে বসুন্ধরা স্পেশাল ইকোনমিক জোন ও ইষ্ট-ওয়েস্ট ইকোনমিক জোন, নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও-এ মেঘনা ইন্ডাষ্ট্রিয়াল ইকোনমিক জোন, নরসিংদীর পলাশে এ কে খান অর্থনৈতিক অঞ্চল, কেরানীগঞ্জ-সাভারে আরিশা বেসরকারী অর্থনৈতিক অঞ্চল, ঢাকার বাড্ডায় ইউনাইটেড আইটি পার্ক সিটি লিমিটেড, নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও-এ সোনারগাঁও ইকোনমিক জোন, ময়মনসিংহের ত্রিশালে আকিজ ইকোনমিক জোন, কুমিল্লার মেঘনায় কুমিল্লা ইকোনমিক জোন এবং নারায়ণগঞ্জের রুপগঞ্জে সিটি ইকোনমিক জোন।
একই প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ এশিয়ার আঞ্চলিক অর্থনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন।
তিনি জানান, আমাদের অনুসৃত উন্মুক্ত অর্থনীতি উপ-আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়ন এবং ব্যবসা, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্প্রসারণে উইন-উইন অবস্থান তৈরি করে সাফল্যের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ আড়াই ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি হবে এবং জনপ্রতি মাথাপিছু আয় ১২ হাজার ডলারে উন্নীত হবে।
তিনি আরো জানান, দেশে শিল্প বিকাশ ও বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়াতে আওয়ামী লীগ সরকার বিদ্যমান বিনিয়োগ পরিবেশ আরো উন্নত করার লক্ষ্যে অবকাঠামো উন্নয়ন, শিল্পে বিভিন্ন পরিসেবা, ভূমির নিশ্চয়তা, প্রতিযোগিতামূলক প্রণোদনা এবং ওয়ান স্টপ সার্ভিস প্রদানসহ বিনিয়োগ বান্ধব আইন ও নীতিমালা করেছে।
একই প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী জানান, বেসরকারি খাতের উন্নয়নে আর্থিক নীতিনির্ধারণ ও ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ গঠনে আমাদের সরকারের সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে। বিদেশি বিনিয়োগ আনতে দেশে একশত বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যেখানে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ হবে। শিল্প কলকারখানা গড়ে উঠবে এবং কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে।
তিনি আরো জানান, যুক্তরাজ্যভিত্তিক বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান প্রাইস ওয়াটার হাউস কুপারসের (পিডব্লিইসি) ২০১৫ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ২০৩০ সাল নাগাদ বাংলাদেশ বিশ্বের ২৯তম এবং ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্বের ২৩তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ হবে। যার বর্তমান অবস্থান ৩১তম।
বিদ্যুত উৎপাদন ১৩ হাজার মেগাওয়াট
সরকার দলীয় সংসদ সদস্য মামুনুর রশীদ কিরণের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী জানান, স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের মে মাস হতে ২০১৭ পর্যন্ত বিভিন্ন সরকারের মেয়াদে দেশে মোট ১৩ হাজার ৫৯৬ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপিত হয়েছে। কিন্তু পুরানো বিদ্যুত কেন্দ্র বিভিন্ন সময়ে অবসরে যাওয়ার কারণে বর্তমানে জাতীয় গ্রীডে ১৩ হাজার ১৭৯ মেগাওয়াট বিদ্যুত যুক্ত হয়েছে। বর্তমানে বিদ্যুতের ১৫ হাজার ৩৫১ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭২-১৯৮১ সালে ২৮৬ মেগাওয়াট, ১৯৮২-১৯৯০ সালে ১ হাজার ৫৮৮ মেগাওয়াট, ১৯৯১ সালের মার্চ-১৯৯৬ সালের মার্চ পর্যন্ত ৫৮৮ মেগাওয়াট, ১৯৯৬ সালের জুন হতে ২০০১ সালের জুলাই পর্যন্ত ১ হাজার ২০৮ মেগাওয়াট, ২০০১ সালের অক্টোবর হতে ২০০৬ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ১ হাজার ২৪০ মেগাওয়াট, ২০০৬ সালের অক্টোবর হতে ২০০৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ৩৪৬ মেগাওয়াট এবং ২০০৯ সালের জানুয়ারী হতে ২০০৭ সালের মে পর্যন্ত ৮ হাজার ৩৪০ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন বিদ্যুত জাতীয় গ্রীডে যুক্ত হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী জানান, বর্তমান সরকার দেশের বিদ্যুত চাহিদা পূরণ ও ২০২১ সালের মধ্যে সবার জন্য বিদ্যুত সুবিধা নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে প্রায় ২৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন ক্ষমতা অর্জনের লক্ষ্যে পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এ পরিকল্পনায় জানুয়ারি ২০১৭ হতে ২০২১ সাল পর্যন্ত ১৬ হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার নতুন বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপনের লক্ষ্যে কার্যক্রম অব্যাহত আছে।
বিদ্যুতের চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে গৃহিত পরিকল্পনার অগ্রগতি তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী জানান, বর্তমানে সরকারি খাতে ৬ হাজার ৭০৭ মেগাওয়াট ক্ষমতার ১৬টি এবং বেসরকারি খাতে ৪ হাজার ৬৫৬ মেগাওয়াট ক্ষমতার ১৮টি বিদ্যুত কেন্দ্রসহ মোট ১১ হাজার ৩৬৩ মেগাওয়াট ক্ষমতার ৩৪টি বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণাধীন রয়েছে।
তিনি আরো জানান, সরকারি খাতে ৬ হাজার ৪১৫ মেগাওয়াট ক্ষমতার ১১টি বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ পরিকল্পনাধীন রয়েছে। আগামী জুলাই ২০১৮ নাগাদ ভারত থেকে আরো ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত আমদানির হবে। এছাড়া রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুত কেন্দ্র হতে ২০২৩ সালের মধ্যে ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট এবং ২০২৪ সালের মধ্যে ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট মোট ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত জাতীয় গ্রীডে যুক্ত হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেছেন।
প্রতিবছরে দুই লাখ ক্যান্সারে আক্রান্ত
সরকার দলীয় সদস্য সামশুল হক চৌধুরীর প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী জানান, দেশে প্রতি বছর ২ লাখেরও বেশি মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে। দেশের মোট জনসংখ্যার প্রতি ১০ লাখ মানুষের জন্য একজন ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আছেন। আর এই চিকিৎসাও ব্যয়বহুল। বিশেষ করে দরিদ্র, নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য চিকিৎসা ব্যয় কষ্টসাধ্য- কথাটি সত্য।
তিনি আরো জানান, ক্যান্সারের ঔষধের বিদেশ নির্ভরতা কমাতে এবং উচ্চ মূল্যের ঔষধ সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে আনতে দেশীয় কোম্পানীগুলোকে ক্যান্সারের ঔষধ প্রস্তুতের ব্যাপারে উৎসাহিত করা হয়েছে। এছাড়া ক্যান্সারের চিকিৎসা বিকেন্দ্রীকরণে দেশের পুরাতন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোতে নতুন রেডিওথেরাপী মেশিন সংযোজনের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
বৈদেশিক কর্মসংস্থান খাত থ্রাস্ট সেক্টর
তরিকত ফেডারেশনের এমপি এম এ আউয়ালের প্রশ্নের জবাবে সংসদ নেতা শেখ হাসিনা জানান, বৈদেশিক কর্মসংস্থান খাতকে সরকার থ্রাস্ট সেক্টর হিসেবে ঘোষণা করছে। এ খাতের গুরুত্ব অপরিসীম বিবেচনায় সরকার বর্তমান শ্রম বাজার ধরে রাখার পাশাপাশি নতুন নতুন শ্রম বাজার সৃষ্টির ওপর জোর দিয়েছে। নতুন শ্রম বাজার সৃষ্টির লক্ষ্যে ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশ দূতাবাসসমূহও শ্রম বাজার সম্প্রসারণে কাজ করছে।
তিনি আরো জানান, বিশ্বের ১৬২টি দেশে এক কোটিরও বেশী বাংলাদেশী কর্মী কর্মরত আছেন। বিদেশে যেসকল প্রবাসী অবৈধ অবস্থায় আছে তাদেরকে সংশ্লিষ্ট দেশে অবস্থিত বাংলাদেশ মিশনের মাধ্যমে বৈধকরণ, আইনী সহায়তা প্রদান এবং দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। মানব পাচার প্রতিরোধ, অবৈধ কর্মীদের বৈধতা প্রদানের ব্যবস্থাগ্রহণ, মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম হ্রাসসহ নিরাপদ অভিবাসন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বহুমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে।
আন্তঃদেশীয় মহাসড়ক নেটওয়ার্ক
সরকার দলীয় সদস্য গোলাম দস্তগীর গাজীর প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী জানান, বর্তমান সরকার মহাসড়ক নেটওয়ার্ক উন্নয়নে নিরবিচ্ছিন্নভাবে কাজ করে যাচ্ছে। প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে মহাসড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়নের লক্ষ্যে সরকার কর্তৃক বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে।
তিনি আরো জানান, ২০১৫ সালের ১৫ জুন ভুটানের রাজধানী থিম্পুতে বিবিআইএন স্বাক্ষরিত হওয়ার ফলে চার দেশের মধ্যে ব্যক্তিগত গাড়ী, যাত্রীবাহী যানবাহন এবং পণ্য পরিবহণের জন্য পণ্যবাহী যান চলাচল করতে পারবে। ইতোমধ্যে ভারত, বাংলাদেশ ও নেপাল চুক্তিটি অনুসমর্থন করেছে। আশা করা যায়, ভুটানও সহসাই চুক্তিটি অনুসমর্থন করবে। চার দেশের অনুসমর্থনের পর চুক্তিটি বাস্তবায়ন হবে।সূত্র- আরটিএনএন