ভারতে জবাই করার জন্য পশু বিক্রি বা পরিবহনের ওপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করে কেন্দ্রীয় সরকার সম্প্রতি যে নির্দেশ দিয়েছে, তা নিয়ে ভারতের অনেক রাজ্য সরকারই ইতিমধ্যেই প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গ বা কেরালার মতো রাজ্যের সরকারগুলোই জানিয়ে দিয়েছে যে তারা ওই নির্দেশিকা পালন করবে না।
তবে এই নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে এবার প্রতিক্রিয়া আসতে শুরু করেছে কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন দল বিজেপি’র অভ্যন্তর থেকেই।
উত্তরপূর্ব ভারতের রাজ্যগুলির বিজেপি নেতারা মনে করছেন, এই নির্দেশিকা পালন করতে গেলে স্থানীয় মানুষের খাদ্যাভ্যাস এবং পরম্পরার সঙ্গে সংঘাত বাঁধতে পারে।
ওই অঞ্চলের অনেকগুলি রাজ্যের অধিকাংশ মানুষই মাংস বলতে প্রধানত গরুর মাংসই খেয়ে থাকেন। অনেক এলাকায় গরু জবাই করাটা ধর্মীয় রীতি-নীতির মধ্যেও পড়ে।
নাগাল্যান্ডের বিজেপি রাজ্য সভাপতি ভিসাসোলি লৌঙ্গউ বলছিলেন, “নাগাল্যান্ডের মানুষ এই নির্দেশিকার ফলে একটা সমস্যায় পড়তে পারেন, আর সেটা হবে জবাই করার জন্য পশু পরিবহনের ওপরে নিষেধাজ্ঞার কারণে।”
তিনি আরও বলেন, “রাজ্যে গরু খুব বেশী নেই। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাছে আমরা আবেদন জানিয়েছি ওই নির্দেশিকা যাতে পুনর্বিবেচনা করা হয়। অনেকেই মনে করছেন যে এটা উত্তরপূর্বের মানুষের খাদ্যাভাসের ওপরে একটা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা হচ্ছে। সেটা দলের পক্ষে খুব একটা ভাল ইঙ্গিত নয়।”
উত্তরপূর্বাঞ্চলে তিনটি রাজ্যে রয়েছে বিজেপি শাসিত সরকার – যার মধ্যে রয়েছে আসাম।
ঐ রাজ্যের দলীয় নেতৃত্বও বলছেন উত্তরপূর্বাঞ্চলে যে হারে বিজেপি এগোচ্ছিল, এই নির্দেশিকার ফলে তার গতি রোধ হয়ে যেতে পারে।
একদিকে যেমন খাদ্যাভ্যাস বা চিরাচরিত প্রথার সঙ্গে এই নিষেধাজ্ঞার কারণে সংঘাত তৈরি হচ্ছে, তেমনই বিজেপি যদি জনজাতি ও খ্রিস্টান-অধ্যুষিত এলাকাগুলিতে শুধুই হিন্দুদের দল বলে চিহ্নিত হয়ে যায়, তাহলেও তা দলের পক্ষে ক্ষতিকারক হবে।
মিজোরামের বিজেপি সভাপতি অধ্যাপক জে ভি লুনার কথায়, “বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ কয়েক বছর আগে যখন এসেছিলেন, তাঁর কাছে স্পষ্ট প্রশ্ন করেছিলাম গরু জবাইয়ের ওপরে নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে। তিনি বলে গিয়েছিলেন যে রাজ্যের বেশীরভাগ মানুষই যেহেতু খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী, তাই যদি বাইবেলে গরুর মাংস খাওয়ায় নিষেধ না থাকে, তাহলে এ রাজ্যের মানুষ গরুর মাংস খেতেই পারেন।”
“রাজ্যের বেশীরভাগ মানুষের কাছে গরুর মাংসই প্রধান মাংসজাতীয় খাদ্য। আশা করা যায় যে গরুর মাংসের ওপরে জারি করা নিষেধাজ্ঞা মিজোরামে অন্তত চালু করা হবে না। রাজ্য সরকারও সেরকমই আশ্বাস দিচ্ছে। তবে কদিনের মধ্যেই কেন্দ্রীয় সভাপতি রাজ্য সফরে আসছেন, সেই সময়ে চার্চের প্রতিনিধিদের সঙ্গে কেন্দ্রীয় নেতাদের একটা বৈঠকেরও ব্যবস্থা করা হয়েছে” – বলছিলেন মি. লুনা।
আরেকটি বিজেপি শাসিত রাজ্য অরুণাচল প্রদেশের রাজ্য বিজেপি সভাপতি ও প্রাক্তন সংসদ সদস্য তাপির গাও অবশ্য মনে করেন যে গরুর মাংসের ওপরে নিষেধাজ্ঞা নিয়ে অহেতুক জলঘোলা হচ্ছে।
অরুণাচলের অনেক মানুষই গরুর মাংস খেলেও এই ইস্যুতে দলের ওপরে মানুষের সমর্থনের কোনও প্রভাব পড়বে না বলেই তাঁর মত।
মি. গাওয়ের কথায়, “কেন্দ্রীয় সরকার যে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে, সেটা সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে করা হয়েছে। চাষাবাদ বা দুধের জন্য পশু পরিবহন করা যেতেই পারে। শুধু জবাইয়ের জন্য পশু নিয়ে যাওয়া যাবে না।”
“তার ওপরে রাজ্যগুলির হাতেই এই নির্দেশিকা বলবত করার ভার দিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। সেই অনুযায়ী প্রত্যেকটি রাজ্যের মানুষের খাদ্যাভ্যাস, চিরাচরিত প্রথা – এসবের ওপরে ভিত্তি করেই রাজ্য সরকারগুলি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে। বিরোধী দলগুলো অযথা এটা নিয়ে রাজনীতি করছে”, বলছিলেন এই বিজেপি নেতা।
উত্তরপূর্বের অনেকরাজ্য থেকেই দলীয় নেতারা যখন নির্দেশিকা পুনরায় খতিয়ে দেখার কথা বলছেন, তারই মধ্যে কেন্দ্রে নরেন্দ্র মোদীর সরকারের তৃতীয় বর্ষপূর্তি উপলক্ষে মেঘালয় রাজ্য বিজেপি নেতারা আয়োজন করেছিলেন গরুর মাংসের উৎসব।
সেখানে সব সামাজিক উৎসবেই গরুর মাংসের ভোজের আয়োজন করা হয়ে থাকে। কিন্তু কেন্দ্রীয় নেতারা গরুর মাংসের ভোজ করতে মানা করে দেওয়ায় বিজেপি-র দুই নেতা দল থেকে পদত্যাগ করেছেন।
তাঁদেরই একজন, বার্নার্ড মারাক বলছিলেন, “আমাদের কাছে একটা বিষয় প্রমাণ করার দায় ছিল যে বিজেপি গরুর মাংসের ওপরে নিষেধাজ্ঞা চায় না। সেজন্যই নরেন্দ্র মোদী সরকারের তৃতীয় বর্ষপূর্তিতে গরুর মাংস খাওয়ার একটা উৎসব করতে চেয়েছিলাম, সাধারণ মানুষের সামনে সত্যিটা তুলে ধরতে।”
“মেঘালয়ের যে কোনও অনুষ্ঠানে গরুর মাংস একটা অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ । কিন্তু কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব সেই প্রস্তাব পত্রপাঠ নাকচ করে দেন। সাধারণ মানুষের অনুভূতির দিকে নজর দিলেন না তারা। এরপরেও কীভাবে সাধারণ মানুষকে বুঝিয়ে দলে নিয়ে আসা সম্ভব? সেজন্যই পদত্যাগ করেছি” – পদ ছেড়ে দেয়ার কারণ ব্যাখ্যা করেন তিনি এভাবে।
জবাইয়ের জন্য পশু পরিবহন নিষিদ্ধ হয়ে গেলে যে হাজার হাজার মানুষ গরুর বাজার, পশু পরিবহন, কসাইখানা বা মাংসের দোকানের সঙ্গে যুক্ত – ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে তাঁদেরও। বন্ধ হয়ে যাবে দৈনন্দিন আয়ের উৎস।
এঁদেরই একটা বড় অংশের মানুষ তিনটি রাজ্যে বিজেপি-কে ক্ষমতায় এনেছেন – এখন তারা সরে গেলে দলের কী অবস্থা হবে, সেটাই নিয়েই চিন্তিত উত্তরপূর্বের বিজেপি নেতারা।সূত্র- বিবিসি