
চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির প্রথম সেমিফাইনালে ক্রিকেটের জনক বলে খ্যাত ইংল্যান্ডকে টেক্কা দিয়ে নতুন ইতিহাস গড়ল পাকিস্তান। ইংল্যান্ডকে ৮ উইকেটে হারিয়ে ফাইনালে জায়গা করে নেয়ার মধ্য দিয়ে ক্রিকেট বিশ্বে নতুন পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভুত হল সরফরাজের দল।
দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করতে নেমে ওপেনার ফখর জামান আউট হলেও পাকিস্তান ২৮ ওভারে মাত্র ১ উইকেট হারিয়েই তুলে ফেলেছে ১৫৭ রান। এর পর দ্বিতীয় উইকেট আজহার আলী যখন সাজঘরে ফিরে যান তখন ৩২ ওভার ২ বলে পাকিস্তানের সংগ্রহ ১৭৩ রান। এর পর আর কোনো উইকেট খরচ করতে হয়নি তাদের। ৩৭ ওভার ১ বলে খেলে জয়ের বন্দরে পৌঁছে যায় পাকবাহিনী। এই সুবাদে ইতিহাস গড়ে প্রথম বারের মতো চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ফাইনালে পৌঁছে যায় পাকিস্তান।
ইংলিশ বোলারদের বিষ শুষে নিয়ে পাকিস্তানি ব্যাটসম্যানরা যেভাবে ব্যাট শুরুকরেছিল, তাতে শুরু থেকেই বলা যাচ্ছিল, কার্ডিফের সেমি-ফাইনালে পাকিস্তানের জয় নিশ্চিতই! অবশ্য পাকিস্তানের জয়ের রাস্তাটা তৈরি করে দিয়েছে বোলাররাই। সেই রাস্তায় নেমে পাকিস্তানের দুই ওপেনার আজহার আলি ও ফখর জামান ২১.১ ওভারের উদ্বোধনী জুটিতেই করে ফেলেন ১১৮ রান।
আদিল রশিদের শিকার হয়ে এই টুর্নামেন্টেই ওয়ানডেতে অভিষেক হওয়া ফখর জামান ফিরে গেছেন ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় হাফসেঞ্চুরি করে। এক ছক্কা ও ৭ চারে তিনি করেছেন ৫৮ বলে ৫৭ রান। ক্যারিয়ারের ১১তম হাফসেঞ্চুরি তুলে নিয়ে আজহার করেছেন ১০০ বলে ৭৬ রান। তার পর বাবর আজম ব্যাট হাতে করছেন ৪৫ বলে ৩৮ রান এবং মুহাম্মদ হাফিজ করেছেন ২১ বলে ৩১ রান। এরপর আর কোনো উইকেট না হারিয়ে ৮ উইকেটে জয় ছিনিয়ে নেয় সরফরাজরা।
প্রথমবারের মতো চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ফাইনালে ওঠার আশায় পাকিস্তান বুধবার মাঠে নামে বোলিংয়ে দু’দুটি পরিবর্তন এনে। চোটের কারণে ছিটকে পড়েন পেসার মোহাম্মদ আমির। তার জায়গায় পাকিস্তানের ২১৪তম ক্রিকেটার হিসেবে ওয়ানডে অভিষেক হয় বাঁহাতি পেসার রুম্মন রাইসের। ফাহিম আশরাফের পরিবর্তে দলে ফেরেন স্পিনার শাদাব খান। এই দুজনসহ পাকিস্তানের বোলাররা শুরু থেকেই দারুণ বোলিং করেছেন। গ্রুপপর্বে দুর্দান্ত ক্রিকেট খেলা স্বাগতিক ইংল্যান্ডকে ২১১ রানে বেঁধে রাখাটা সেই সাক্ষ্যই দিচ্ছে।
টস জিতে প্রথমে বোলিং নেওয়া পাকিস্তান উইকেট পেতে পারতো ইনিংসের দ্বিতীয় বলেই। কিন্তু জেসন রয়ের পরিবর্তে দলে ঢোকা জনি বেয়ারস্টোর বিপক্ষে জুনাইদ খানের আবেদনে আম্পায়ার সাড়া দেননি। পাকিস্তান অবশ্য রিভিউ নিয়েছিল। রিপ্লেতে পরিস্কার, উইকেটে পিচ করা বলটি উড়িয়ে নিত বেয়ারস্টোর অফ স্টাম্পের বলে। কিন্তু রিভিউতে আম্পায়ারের সিদ্ধান্তই বহাল থাকে। তবে উইকেটের জন্য পাকিস্তানিদের খুব বেশি সময় অপেক্ষা করতে হয়নি। ষষ্ঠ ওভারেই অ্যালেক্স হেলসকে বাবর আযমের ক্যাচ বানিয়ে পাকিস্তানকে প্রথম ব্রেক থ্রু দেন রুম্মন রাইস। হেলস ১৩ বলে ১৩ রান করে ফিরে যাওয়ার পর বেয়ারস্টো, জো রুট, ইয়ন মরগান, বেন স্টোকসরা চেষ্টা করেছেন বড় ইনিংস খেলার। কিন্তু তাদের কারো স্বপ্নই সফল হতে দেননি পাকিস্তানি বোলাররা।
আম্পায়ারের বদান্যতায় শূন্য রানে বেঁচে যাওয়া বেয়ারস্টোকে ফিরিয়ে দিয়ে পাকিস্তানকে দ্বিতীয় ব্রেক থ্রু দেন হাসান আলি। এই হাসান আলি পরে ফিরিয়েছেন ইংল্যান্ড অধিনায়ক ইয়ন মরগানকেও। যিনি ১৯ রানে দাঁড়িয়ে পুনর্জীবন পেয়েছিলেন রিভিউ নিয়ে। ব্যাট হাতে নামার পরই একটা কীর্তি গড়েন মরগান। ৩ রান করতেই ইংল্যান্ডের তৃতীয় ক্রিকেটার হিসেবে ছুঁয়ে ফেলেন ওয়ানডেতে ৫ হাজার রানের মাইলফলক। এই মাইলস্টোন পেরোনোর পর আবার নতুন জীবন লাভ। তারপরও সফল হতে পারেননি ইংলিশ অধিনায়ক। ৩৩ রানে তাকে ফিরিয়ে দেন হাসান আলি। এরপর জস বাটলার ও মঈন আলিকে পরপর ফিরিয়ে দিয়ে ইংল্যান্ডকে রীতিমতো চেপে ধরেন জুনাইদ খান।
কারণ, ১৬২ রানেই ৬ উইকেট হারিয়ে ফেলে ইংল্যান্ড। দলকে ১৮১ রানে রেখে রান আউট হয়ে ফিরে যান আদিল রশিদও। এরপরও ইংল্যান্ডের স্কোর ২০০ পেরিয়ে গেছে বেন স্টোকসের সুবাদে। সময়ের অন্যতম সেরা অল-রাউন্ডার একপ্রান্ত আগলে রেখে করেছেন ৬৪ বলে ৩৪ রান। গত বছর দুয়েক ধরে সেঞ্চুরি-হাফসেঞ্চুরি করাটাকে ডাল-ভাত বানিয়ে ফেলেছেন ইংলিশ বোলাররা! কার্ডিফের সেমি-ফাইনালে সেই ইংল্যান্ডের ইনিংসে একটা হাফসেঞ্চুরিও নেই! সর্বোচ্চ ৪৬ রান করেছেন জো রুট। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৪৩ রান করেছেন শূন্য রানে বেঁচে যাওয়া বেয়ারস্টো। ইংল্যান্ডের পুরো ইনিংসে কোনো ছক্কা নেই। চার মাত্র ১৫টি। ২০১৫ বিশ্বকাপের পর থেকে এ পর্যন্ত ২৫ ওভারের বেশি খেলা হয়েছে, এমন ইনিংসে এটাই সর্বনিম্ন বাউন্ডারির রেকর্ড!
পাকিস্তানের সব বোলারই দারুণ বোলিং করেছেন। তবে উইকেট প্রাপ্তির দিক থেকে এগিয়ে হাসান আলি। তিনি নিয়েছেন ৩ উইকেট। এই ৩ উইকেট নিয়ে এবারের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে ৪ ম্যাচে হাসান আলির উইকেট হলো টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ ১০টি। যা চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ইতিহাসেই এক আসরে কোনো পাকিস্তানি বোলারের সর্বোচ্চ উইকেট। আগের সর্বোচ্চ ৮ উইকেট ছিল সাঈদ আজমলের। জুনাইদ ও ডেব্যুট্যান্ট রুম্মন রাইস নিয়েছেন দুটি করে উইকেট। শাদাব খান একটি। বাকি দুটি রান আউট।
ইংল্যান্ড একাদশ : ইয়ন মরগান, আলেক্স হেলস, জনি বেয়ারস্টো, জো রুট, বেন স্টোকস, জস বাটলার, মঈন আলি, আদিল রশিদ, লিয়াম প্লাঙ্কেট, জেক বল ও মার্ক উড।
পাকিস্তান একাদশ : সরফরাজ আহমেদ, আজহার আলি, ফাখর জামান, বাবর আযম, মোহাম্মদ হাফিজ, শোয়েব মালিক, ইমাদ ওয়াসিম, হাসান আলি, রুম্মন রাইস, জুনায়েদ খান ও শাদাব খান।